Thursday, November 14, 2013

শেষ বিকেলের গল্প

লিখেছেন - Ðisappeared ShaÐow 

:হ্যালো ভাইয়া।
:বলো
:ভাইয়া আপনি আমাকে ফোন দেন না ক্যান?
:ব্যস্ত থাকি তো। বোঝই তো মেডিকেলের স্টুডেন্ট।
:এইটা কোন কথা না। আপনি ইচ্ছা করলেই আমাকে ফোন দিতে পারেন। আপনি কেন দ্যান না?
:বললামই তো একটু ব্যস্ত থাকি।
:এখন কি ব্যস্ত?
:না একটু ফ্রি। রাতে ডিউটি আছে।
:ভাইয়া।
:বল
:না থাক কিছু না।
:আচ্ছা ঠিক আছে।
:আপনি কি জানতে চান না?
:কি জানতে চাইব?
:উফ। আপনি একটা ছাগল।
:ঠিক বলেছ আমি ছাগল।
:আপনি গাধা একটা।
:হ্যা আমি গাধা।
:ধুরর!!!
:কি হয়েছে?
:কিছুনা।
:আচ্ছা।
:ভাইয়া।
:বলো
:আপনার মনে আছে?
:কি?
:আমি ছোট থাকতে ১ম একটা চিঠি দিয়েছিলাম আপনাকে?যখন আপনারা আমাদের পাশের বাসায় ছিলেন?
:হুম মনে আছে?
:পড়েছিলেন?
:খেয়াল নেই
:কি লিখেছি মনে আছে?
:না মনে নেই।
:ও। কি করেছেন চিঠিটা?
:মনে নেই।
:আপনি এরকম কেন?
:কিরকম?
:কেমন বোকা বোকা।
:জানি না তো
:আপনি কি আগের মতই আছেন ? নাকি মোটা হয়েছেন আরো?
:হুম মোটা হয়েছি।
:ভাবি মাইর দেয় না।
:থাকলে অবশ্যই দিত।
:আপনাকে আমার মাইর দিতে ইচ্ছা করে। দেই?
:দাও।
:না থাক। বোকা মানুষকে মারা ঠিক না। মা নিষেধ করেছেন। আপনি একজন সহজ সরল বোকা সোকা ভদ্র ভাল মানুষ।
:হুম
:বিয়ে করবেন কবে?
:দেরী আছে
:কেন?
:টাকা পয়সা নাই। বউ না খেয়ে মারা যাবে।
:আন্টি কেমন আছেন?
:ভালো। তোমার বাবা মা?
:ভাল। আপনার ছোট বোন কিসে পড়ে?
:ইন্টার।
:ঢাকায়?
:হুম।তোমার বড় ভাই কোথায় এখন?
:ভাইয়া বিদেশে। সামনের মাসে আসবেন।
:ও আচ্ছা।
:আপনি এমন ক্যান। জানেন আমি আপনাকে সেই ক্লাস এইট,এস এস সি, এইচ এস সি সব কিছুর রেজাল্ট জানিয়েছি। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে আমি আপনাকেই প্রথম জানাই?
:না জানতাম না। এখন জানলাম।
:আপনি আমাকে কখনই বুঝলেন না।
:হয়ত
:আসলেই আপনি বোঝেন না।
:হুম
:আপনাকে আমি মোট আটটা চিঠি দিয়েছিলাম। একটাও পড়েছেন?
:মনে নেই।
:কই সেগুলো?
:জানি না।
:থাক জানার দরকার নেই।একটা কথা ছিল।
:বলো
:আপনাকে আমার এটাই শেষ কল।আমি আর আপনাকে ফোন দিব না।
:এই নিয়ে কয়বার বলেছ এমন?
:অনেকবার। কিন্তু এবার আমি সিরিয়াস।
:ও আচ্ছা।
:ভাইয়া
:কি?
:আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। সামনের মাসের শেষে বিয়ে। ভাইয়া অবশ্যই আসবেন। আপনাকে এ কথা জানাতেই ফোন দিয়েছি। কার্ড ছাপানো শেষ। আপনাদের বাসায় কয়েকদিনেই তা পৌছে যাবে।
:কংগ্রাটস!!
:বিয়েতে আসবেন।
:অবশ্যই আসব।
:ভাইয়া
:কি?
:একটা কথা বলতে চাই।
:বল
:আপনি কি আমাকে ভালোবাসেন না?
:জানি না,মনে হয় না।
:আপনি একটা মিথ্যুক।
:তুমিও মিথ্যুক।
:কেন???
:এ নিয়ে ৪ ৫ বার তোমার বিয়ের কথা আমায় বলেছ।সবই মিথ্যা।এবারেরটাও মিথ্যা।
:তারমানে আপনি আমাকে ভালোবাসেন?
:(চুপ)
:প্লিজ ভাইয়া একবার শুধু শুনতে চাই আপনার মুখ থেকে,প্লিজ।
:বোকা মেয়ে ফোন রাখ। বোকা বোকা কথা বলা বন্ধ করো।
:(কিছুক্ষন চুপ করে থেকে) ভাইয়া এবার আমি সত্যিই বলছি।
:ওকে
:আমি আপনাকে ভালোবাসি।
: .......
:রাখি ভাইয়া। আর কথা হবে না
: .......
:রাখি
:রাখো।


:আপনি একটা ভীতুর ডিম
:হুম।
মেয়েটা ফোন রেখে দিলো। পরে আসলেই ওর বিয়ের কার্ড পেয়েছিলাম। বাসার সবাই গিয়েছিল।আমি যাই নি।
আকাশে কালো কালো মেঘ। পশ্চিমে একটু খোলা আকাশের সন্ধান পেয়ে তা থেকেই ঠিকরে পড়ছে আলো। বৃষ্টির দিনে বুড়িগঙ্গার পানি পরিষ্কার। ক্যাম্পাসের পেছনের গেট থেকে বের হয়ে সোজা বুড়িগঙ্গার পাড়ে যাই। গুনে গুনে আটটা কাগজের নৌকা বানাই ও ছেড়ে দেই।নৌকাগুলো ভেসে যাচ্ছে।
শেষ বিকেলের আলো,নদীর জলে প্রতিফলন তার মাঝে নৌকাগুলোর ভেসে যাওয়ার দৃশ্যটা সত্যিই অদ্ভুত। সেদিকে তাকিয়ে আছি। যতক্ষণ পারলাম তাকিয়ে ছিলাম। ফিরে আসার আগ মুহুর্তে মনে হল আমি কাঁদছি। সূর্য অস্ত গেল। ধীরে ধীরে মনের মত, ব্যস্ত শহরটাও একসময় ডুবে গেল অন্ধকারে।
কেমন যেন একটা হাহাকার।
অদ্ভুত সেই অনুভূতি।

Wednesday, November 13, 2013

অশ্রুকন্ন্যা

নিহিন শক্ত করে আমার হাত ধরে রেখেছে । কিছুতেই যেন আমাকে যেতে দিবে না কোথাও ! আমি নিহিনের দিকে তাকিয়ে দেখি ওর চোখে পানি চলমল করছে । যে কোন সময় পানি গড়িয়ে পড়বে ।
আমার মাঝে মাঝে অবাক লাগে এই ভেবে যে এই চিকন শরীরে এতো পানি আসে কোথা থেকে !
কোন কথা নাই বার্তা নাই, কেমল নায়াগ্রার জলপ্রপাতের মত পানি পড়তেই থাকে ।
আমি যদি ওকে একটু ধমক দিয়ে কথা বলি তাহলে ওর চোখ দিয়ে পানি পড়ে!
যদি একটু আদর করি তাহলে পানি পড়ে !
দেখা হলে পানি পড়ে !
আবার যখন ওকে রেখে আসতে যাই তখনও পানি পড়ে !
এতো পানি আসে কোথা থেকে কে জানে ?
আমি একটু ভয়ে ভয়ে ওর দিকে তাকাই । মেয়েটা কি এখনই কেঁদে ফেলবে ? নিহিন চোখে গাড় করে কাজল দিয়েছে । এখন যদি কেঁদে ফেলে তাহলে চোখের কাজল লেপ্টে একাকার হয়ে যাবে !
তার উপর আজ আবার সাদা সেলোয়ার কামিজ পরে এসেছে । মেয়েটাকে কত দিন বলেছি যেদিন তোমার কান্না কাটি করার মুড থাকবে সেদিন চোখে কাজল পরবে না ।
কিন্তু না !
আমার সাথে দেখা করতে আসতে হলে তার কাজল পরা চাই ই ।
আমিই ওকে একদিন বলেছিলাম চোখে কাজল দিলে অনেক সুন্দর লাগে ! আর যাবে কই !
নিহিন চোখের পানি আটকানোর আপ্রান চেষ্টা করে যাচ্ছে ! আমি খানিকটা বিরক্ত হয়ে বললাম
-এই জন্য আমি তোমাকে আসতে মানা করেছিলাম । মাত্র দুদিনের জন্য যাচ্ছি এর জন্য এতো কান্নাকাটি করার কি আছে ?
নিহিন বলল
-কই কান্না কাটি করছি ? কাঁদছি না আমি !
এই কথা বলতে বলতে নিহিনের চোখ দিয়ে টুপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল । নিহিন ব্যস্ত হয়ে পড়ল পানি মোছার জন্য ! আমি ওকে বললাম
-এটা কি ?
নিহিন চোখ মুছতে মুছতে আমার দিকে তাকালো ! তারপর বলল
-আমি কি করবো বল ! তুমি আমার কাছ থেকে দুরে যাচ্ছ এটা আমি মেনে পারছি না । এই কয় দিন আমি তোমার কাছ থেকে কিভাবে দুরে থাকবো !
আমি কিছু বলতে গিয়েও আটকে গেলাম । মেয়েটাকে জোরে কিছু বলতেও পারি না ।
কিভাবে বলি !!

যেদিন থেকে শুনেছে আমি একটু ঢাকার বাইরে যাবো সেদিন থেকে ই ও এমন করছে !
বারবার বলছে
-এতোদিন আমি কিভাবে থাকবো ? আর কেন যাবা ? কি দরকার ?
-আরে কি দরকার মানে ? আমার ছোট বেলার বন্ধুর বিয়ে ! না গেলে হয় নাকি ? বন্ধু রাগ করবে না ?
নিহিন চোখে পানি নিয়ে বলল
-বন্ধু রাগ করবে ঠিক আছে আর আমি ? আমার কথা ভাববে না ? আমি কষ্ট পাবো না ?
-আরে বাবা ! আমি তো আর চিরো দিনের জন্য যাচ্ছি না । মাত্র দুইদিনের জন্য!
-দুইদিনের জন্যই কেন যাবা ? আমি কিভাবে থাকবো?

আমি টিস্যু দিয়ে নিহিনের চোখ মুছিয়ে দিলাম । একটু সাবধানে চেষ্টা করতে করলাম কিন্তু শেষ রক্ষা হল না । কাজল লেপ্টে কেমন একটা বিষ্ছিরি অবস্থা হল !
আমি বললাম
-আমি এই জন্য তোমাকে আস্তে মানা করে ছিলাম । এখন যাওয়ার সময় তোমার এমন কান্না ভেজা মুখ দেখতে ভাল লাগে !
নিহিন ফুপিয়ে কেঁদে উঠল !
হায় আল্লাহ !! আমি কই যাবো !!
-আমাকে ছেড়ে যাবে আমি একটু আসতেও পারবো না ? শেষ দেখা হবে না ?
এই মেয়েকে নিয়ে আমি কোথায় যাবো ? শেষ দেখা মানে কি ?
আমি বললাম
-আমি যুদ্ধে যাচ্ছি ? এমন ভাবে কথা বলছো যেন আমি আর আসবো না ! আমি আসবো না কি আর ?
নিহিন চোখ মুছতে মুছতে বলল
-যেও না প্লিজ ! তুমি জানো না তোমাকে না দেখলে আমার কেমন হয় ? আমি ঠিক মত নিঃশ্বাস নিতে পারি না !

নাহ ! এই মেয়েটার সাথে কথা বলে লাভ নাই । যত কথা বলবো তত আমার মনকে কনফিউজ করে দিবে ! তখন মনে হবে আমার বুঝি যাওয়া ঠিক হবে না !
আমি নিহিনের হাত থেকে নিজেকর ছাড়িয়ে নিলাম । বললাম
-আমার বাস ছাড়ার সময় হয়ে গেছে । আমি যাই !
নিহিন অনিচ্ছা সত্তেরও আমার হাত ছেড়ে দিল । আমি বাসের দরজায় উঠে পিছনে তাকালম !
নিহিনের চোখ দিয়ে আবার পানি পরছে !
এসব কি ভাল লাগে ?
যাওয়ার সময় একটু হাসবে !
একটু হাসি মুখে বিদায় দিবে । কিন্তু না ! কেঁদেই চলেছে …….
আমি জানলা দিয়ে মুখ বের করে তাকালাম ! হাত নাড়লাম ।
নিহিন হাত নাড়ল না !
আমার দিকে তাকিয়েই রইলো ! চোখ দিয়ে তখনও পানি পড়ছে অনবরত !
চোখ থেকে পানি আর কাজলের মিশ্রনের একটা কালো পানি ধারা ওর গাল বেয়ে নিচে নামছে !

বাস চলতে শুরু করলো ! আমি আবার হাত নাড়লাম । ঠিক তখনই নিহিন একটা পাগলামো করা শুরু করলো ! বাসের সাথে সাথে হাটতে লাগলো !
যাসের গতি আস্তে আস্তে বাড়তে লাগলো আর নিহিনের হাটার গতিও বাড়তে লাগলো !
এক পর্যায় নিহিন দৌড়াতে লাগলো ! আমি চিৎকার করে থামতে কিন্তু নিহিন আমার কথা শুনো না !
ওর মুখ দেখে মনে হচ্ছে ওর প্রিয় কিছু ওর কাছ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে । বাচ্চা মেয়ে যেমন আর হারিয়ে যাওয়া জিনিসের জন্য দৌড়ায় নিহিন ঠিক সেভাবেই দৌড়াতে লাগলো !
এই মেয়েটা আসলেই পাগল !
এমন পাগলামো কেন করছে !
এভাবে কেউ বাসের সাথে সাথে দৌড়া্ড় ?

এক পর্যায়ে নিহিন বাসে আড়ালে চলে গেল । কিন্তু আমার কেন জানি মনে হল নিহিন এখনও দৌড়াচ্ছে ! আমি নিহিনকে ফোন দিলাম !
ও ধরছে না ।
কি করবো ?
নাহ !!
এই মেয়ে আমাকে শান্তি দিবে না ।

আমি বাসের ড্রাইভার কে বাস থামাতে বললাম । ড্রাইভার একটয় অবাক হলেও কিছু বলল না । আমি বাস থেকে নেমে পড়লাম ! আমি জানি না কেমন এমন মনে হচ্ছে কিন্তু আমি জানি নিহিন এদিকেই দৌড়ে আসছে !
আমি নিজেও হাটতে লাগলাম ওর দিকে !
এই তো নিহিনকে দেখা যাচ্ছে !

এখনও দৌড়েই যাচ্ছে !! আমার কাছে এসে একটু থামলো ! তারপর আমাকে জড়িয়ে ধরলো ! এতো মানুষ চারি ধরে কিন্তু নিহিনের কোন ক্ষ্যাল নাই !
ওর বুকটা কেমন ধরফর করছে ! নিহিন কোন রকম বলল
-আর কখনও আমাকে ছেড়ে যাবে না ! আর কখনও না !! আমি আর কখনও তোমাকে যেতে দিবো না ! দিবো না !

আমি আর কিছু বললাম না । বললাম পরতে পারলাম না ! এই মেয়ের ভালবাসার কাছে আমার আর কিছু বলারও নাই !
কিন্তু বন্ধুর বিয়েতে যেতে পারলাম না । না জানি ও কি বলবে !!!

বাস্তবের নিহিন রা কখনও এমন হয় না !! বাস্তবের নিহিনরা কখনও এভাবে ভালবাসতে পারে না ! তাদের সেই ক্ষমতাই নেই !!

বৃষ্টি আমার চোখের পাতা ছুঁয়ো না

 

“আমার গল্পটি হয়তো পরকীয়ার কোপানলে দগ্ধীভূত হতে পারে। হতে পারে কোনো কুলবালা নাক সিঁটকিয়ে বলে উঠবেন, মর জ্বালা! ছেনালির গল্প শুনবার সময় নাই! কিংবা কোনো কট্টরপন্থী বলে উঠতে পারেন, এভাবেই আমাদের মেয়েগুলো নষ্ট হচ্ছে। বেশরম! কিন্তু প্রিয় পাঠক, আমাকে যে এ গল্প বলতেই হবে! আমার কপালে বেশরম বা ছেনাল তকমা জুটলেও আমাকে কেউ মুখ চাপা দিয়ে নির্বাক করে দিতে পারবে না। বাংলাদেশই শুধু নয়, বিশ্বের লক্ষ লক্ষ নারী আছেন স্বজন অথবা বাইরে কটু কথা শুনতে হবে বলে নানাবিধ অত্যাচার মুখ বুজে সয়ে যান বছরের পর বছর। যদিও মেয়েরাই মেয়েদের এমন অবস্থার ভেতর থাকতে বাধ্য করছেন পরিবার থেকেই, আর সে অবস্থার যদি…। “
যাহ, লেখাটাও বুঝি গেলো! আর কখন যে বিদ্যুৎ ফিরে আসবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। মনে মনে নিজের অদৃষ্টকে গালি দিতে দিতে কম্পিউটারের সামনে থেকে উঠে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়ায় তমা।
বলতে গেলে আজ পুরোটা দিনই বিদ্যুতের আসা-যাওয়ার খেলায় বেশ বিরক্ত ছিলো সে। তবে দিনটির বেজায় একটা ভালো দিকও ছিলো, আর তা হলো, পুরোটা দিনই ছিলো থেমে থেমে বৃষ্টি। কখনো মুষল ধারে, কখনো বা টিপটিপ, ঝিরঝির। মায়ের চোখ এড়িয়ে একবার ছাদে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে এসেছে সে। তখন থেকেই খুক খুক করে কাশি আরম্ভ হয়েছিলো। মা যাতে শুনতে না পান তাই ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলো তখন। কাশি উঠলেই মুখের ওপর টাওয়েল চেপে ধরছিলো। ঘণ্টা খানেকের ভেতর কাশির পরিমাণ কমে যেতেই সে আবার ছাদের দিকে যাচ্ছিলো একই উদ্দেশ্যে। কিন্তু তখনই কেমন করে যেন মা টের পেয়ে গেলেন। তমা, ‘ছাদে যাস না! বৃষ্টি হচ্ছে দেখছিস না?’
মায়ের কাছে ধরা পড়ে গেলেও তা প্রকাশ না করে সে বললো, ‘ছাতা নিয়ে যাবো তো!’
‘কী আছে ছাদে? বল, আমি এনে দিচ্ছি!’ বলতে বলতে হাতের কাজ ফেলে উঠে এলেন তিনি।
হঠাত করে কিসের কথা বলবে তা ভেবে না পেয়ে কেমন বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকালো মায়ের দিকে। তখনই মা হেসে উঠে বললেন, ‘আচ্ছা মেয়ে, তুই কি নিজের ভালো-মন্দ বুঝবি না? বড় হচ্ছিস না তুই?’
মায়ের কথা শুনে তখনই তার ভীষণ কান্না পায়। তার মা’টা কেন এত ভালো? এ পর্যন্ত রাগতে দেখেনি কখনো, মারপিট তো দূরের কথা। দেখতে কেমন সুন্দর! মুখটা দেখলেই মনের ভেতরটা গলতে আরম্ভ করে। ইচ্ছে হয় তখনই মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলে- মা একটু আদর করে দাও। কিন্তু ছেলেবেলার মতো করে এমন কথা বলতে সে পারে না। কথাটা ভাবলেই ভীষণ লজ্জা এসে তার দু চোখের পাতাকে জোর করে নামিয়ে দেয়। মায়ের দিকে তাকাতে পারে না। মনে হয় চোখ দুটো দেখলেই তিনি মনের কথাটা বুঝে ফেলবেন। অবশ্য মাঝে মধ্যে কড়া কড়া কথা বলার ভান করেন, কিন্তু কণ্ঠস্বরে তা ফোটে না ভালো মতো। যদিও টিভিতে বা মঞ্চে মা’র অভিনয়ের যথেষ্ট সুনাম আছে, তবু মেয়ের সঙ্গে অভিনয়টা ভালো পারেন না। ঠিক যেন বৃষ্টির মতোই এক ধরণের স্নিগ্ধতা তাকে জড়িয়ে রাখে সারাক্ষণ। যত জোরেই বৃষ্টি হোক না কেন, বৃষ্টির প্রতি যেমন তার বিরক্তি আসে না কখনো, তেমনি মায়ের প্রতি তার মনটা ভালোবাসায় টুবু টুবু হয়ে থাকে সব সময়। এমন মাকে সে কোন প্রাণে ছেড়ে যাবে?
পৃথিবীর সব কিছুই কোনো না কোনো নিয়ম মেনে চললেও মাঝে মাঝে অনেক অনিয়মও ঘটে। আর সেই অনিয়মের সূত্র ধরেই তাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে এই সুন্দর পৃথিবী। পৃথিবীর সুন্দরতম জননীকে। ছেড়ে যেতে হবে প্রিয় শহর ঢাকাকে। যে শহরে সে প্রথম দেখা পেয়েছিলো তার জীবনে দেখা সুন্দরতম পুরুষটিকে। যাকে অবলম্বন করে নতুন করে বাঁচার স্বপ্নে বিভোর হয়ে গিয়েছিলো। তার আবাল্য স্বপ্নের মানুষটিকে ঘিরে লতিয়ে ওঠা তার বিভিন্ন ছোট্ট ছোট্ট চাওয়া আবিদের মাঝে এমন কানায় কানায় পরিপূর্ণ দেখতে পাবে, তা কখনো ভাবেনি। সব জেনে শুনে, অসুখের কারণে কঠিন নিয়মানুগ জীবনের কথা জেনেও তাকে ভালোবাসতে ভয় পায়নি যে। অন্য কোনো ছেলে হলে হয়তো বলতো, ‘এত এত নিয়ম-কানুন ভালো লাগে না। বোরিং!’
আবিদ কী একটা কথায় একবার বলে উঠেছিলো, ‘ভালো বাসলে দোষ-গুণ দুটোকেই ভালো বাসতে হয়। নির্দোষ কিছু পৃথিবীতে আছে নাকি?’
সেই আবিদ। সরল রেখার মতোই ছিলো যার ভাবনাগুলো। এমনটি তার প্রত্যাশিত থাকলেও ততটা আশা করেনি। কিন্তু তার ক্ষেত্রে ব্যাপারটি সত্যিই ঘটেছিলো। আর সব ঘটনাই এক সময় ইতিহাস হয়ে যাওয়ার মতোই আবিদও তার জীবনে এখন ইতিহাস। তার বেশি কিছু নয়।
ভাবতে ভাবতে কখন তার চোখের জল আর বৃষ্টির ছাট এসে লাগা চোখের কোল অশ্রু আর বৃষ্টিতে মাখামাখি হয়ে যায় বুঝতে পারে না। মায়ের ডাক শুনতে পেলেও তার ইচ্ছে করছিলো না বারান্দা থেকে সরে যেতে। কিন্তু আর খানিকটা দেরি হলেই মা দরজায় এসে দাঁড়াবেন। যতক্ষণ সে দরজা না খুলবে ততক্ষণ তিনি ক্রমাগত নক করে যেতে থাকবেন।
মায়ের আরেকটি ডাক ভেসে আসতেই তমা বারান্দা থেকে বলে উঠলো, ‘কারেন্ট আসুক মা!’
আজ হয়তো আর আসবে না। এক্ষুনি চলে আয়!
খাবার টেবিলে হঠাত বাবাকে দেখতে পেয়ে অকারণেই যেন বুকের ভেতরটা দুরু দুরু করে উঠলো তমার। ভেতরে ভেতরে বিস্ময়ের খাবি খেলেও কোনো রকমে বলে, ‘কেমন আছ বাবা?’ ছ মাসের ভেতর বাবার সঙ্গে এক টেবিলে বসেছিলো কি না মনে করতে পারে না তমা। ভেতরে ভেতরে বাবার সঙ্গ পেতে বেশ কিছুদিন ধরেই ছটফট করছিলো। ইচ্ছে করছিলো এক্ষুনি ছুটে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু ছোটোবেলা থেকেই অন্যদের সামনে নিজের আবেগ জনিত দুর্বলতাকে লুকিয়ে রাখতে অভ্যস্ত সে। তাই নির্বিকার ভাবে চেয়ার টেনে বসতে বসতে সে আবার বললো, ‘অনেক দিন পর আমাদের সঙ্গে খেতে বসলে।‘
মিটি মিটি হাসিতে নিজের চেহারাটা উজ্জ্বল করে তুলে বাবা হঠাত বলে উঠলেন, ‘তোর জন্যে একটু ভালো খবর আছে। তাই খানিকটা সময় চুরি করলাম তোর জন্যে!‘
এত কষ্টের ভেতরও বাবার কথায় না হেসে পারে না তমা। ‘ভালো একটু হয় কী করে? একটু আর একটাতে কোনো পার্থক্য নেই?’
‘পার্থক্যটাও তো আপেক্ষিক। যেমন পার্থক্য ক্যাপ্টেন আর ল্যাপ্টেনে।‘
বাবার কথাটা শুনেই কান কেমন খাড়া হয়ে উঠলো তমার। মনে হলো পুরো শরীরটা কোনো এক আকস্মিক সংবাদ গ্রহণের আগাম সতর্কতা হিসেবে খানিকটা ঋজু হয়ে উঠলো যেন। বাবা কি ইঙ্গিতে কিছু বোঝাতে চাচ্ছেন? আবিদকে কেন যেন তিনি পছন্দ করতে পারতেন না। অবশ্য তার সঙ্গে মিশতে কখনো বাধাও দেননি। বিচক্ষণ আর মেয়েকে ভালোবাসেন বলে আবিদের প্রতি নিজের অপছন্দ প্রকাশে লেফট্যান্যান্ট না বলে বলতেন ল্যাপ্টেন।
খেতে খেতে বাবা হঠাত তমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, ‘আজ তো বেশ বৃষ্টি হয়েছে, ক’বার ভিজেছিস?’
তমা কিছু বলার আগেই মা তমার পাতে কালিজিরা শাকের ভর্তা তুলে দিতে দিতে বললেন, ‘সোনামনি আজ সেই চান্সটা পায়নি। একবার দেখলাম গুটগুট করে ছাদের দিকে যাচ্ছে। তখনই দিলাম এক ধমক! তার আগে দু’বার কাশতে শুনেছিলাম।‘
মায়ের কথা শেষ হতেই বাবা বললেন, ‘তাহলে দ্বিতীয় বার যাওয়ার সময় তুমি ধরতে পেরেছিলে।‘
‘মানে?’ অবাক হয়ে মা মুখ তুললেন।
বাবার মুখে আবার সেই মিটিমিটি হাসিটা ফিরে এলো। ‘বৃষ্টির পানি মাথায় না পড়লে কাশি হওয়ার কথা নয়। কথাটা তুমিও জানো।‘
মা আবাক বিস্ময়ে তমার দিকে তাকালে সে হাসি চাপতে পারলো না। তখনই মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘তোমার চোর মেয়েকে কেন যে পেটে ধরেছিলাম!’
‘মা, মিনিট পাঁচেকের বেশি ভিজিনি!’
‘আমি কোথায় ছিলাম?’
‘স্ক্রিপ্ট হাতে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছিলে।‘
‘শুনলে তো?’
বাবার কাছে নালিশের মত করে প্রশ্ন রাখতেই তমা বলে উঠলো, সরি মা!’
তমার কথা শুনে মা রেগে উঠার মত করে বললেন, ‘গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ে সরি বললে লাভ নেই!’
অনেক সময় নিয়ে খাওয়া শেষ করলেও বাবার মুখ থেকে আর কোনো কথা বের হলো না। কিন্তু তার মনে হলো বাবার কথাতেই যাবতীয় রহস্য লুকিয়ে আছে। তখনই তার মনে পড়লো খবরটাতে পদবী জনিত কোনো ত্রুটি ছিলো না তো? এক্ষুনি ছুটে গিয়ে আবিদ সংক্রান্ত পত্রিকার সংবাদের কাটিংগুলো বের করে দেখতে ইচ্ছে করছিলো। হুট করে বাবার সামনে থেকে উঠে যেতে ইচ্ছে না করলেও ভেতরকার ছটফটে ভাবটা গোপন করতে পারছিলো না সে।
একমাত্র মায়ের চোখেই হয়তো সন্তানের মনের অস্থিরতা গোপন থাকে না। তাই হয়তো তিনি বলে উঠলেন, ‘যা তো, বাবার সামনে বসে থাকতে হবে না! দরজা জানালা খুলে রাখিস না কিন্তু!’
তমা বাবার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘দেখলে বাবা?’
তিনি হেসে বললেন, ‘যাও আম্মু! শুয়ে পড় গিয়ে!’
তমা ইচ্ছে করেই খানিকটা সময় নেয় নিজের রুমে ঢুকতে। আর প্রায় নিঃশব্দে দরজা বন্ধ করে দিয়ে চার্জ লাইট জ্বালায়। পত্রিকার কাটিংগুলো বের করে একটি ব্যাপার আবিষ্কার করে কাঁপতে কাঁপতে বিছানায় গড়িয়ে পড়ে। আর তা হলো, শুধু লেফট্যান্যান্ট আর ফ্লাইট লেফট্যান্যান্ট-এর মাঝে বিস্তর ব্যবধান। একজন ভূমিতে আরেকজন আকাশে। তাহলে তার আবিদ ভালোই আছে।
প্রায় এক সপ্তাহ পর হঠাত করেই সেল ফোনটা বেজে উঠলো। যে নাম্বারটা কেবল আবিদই জানে। দুরু দুরু বুকে কলটা রিসিভ করেই কান্না আরম্ভ করলো সে। ওপাশ থেকে আবিদের কণ্ঠে শুনতে পেলো, ‘তমা আমি ল্যাংড়া হইয়া প্রমাণ করিলাম যে, এখনো বাঁচিয়া আছি। শীঘ্রই খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে ক্র্যাচে ভর দিয়া তোমার সম্মুখে উপস্থিত হইবো প্রত্যাশা করি!’
গভীর রাতে বিদ্যুৎ এলেও সে অন্ধকারেই বসে থাকে বারান্দায়। জগতের যাবতীয় ভালো লাগা যেন তাকে আজ জাপটে ধরে রেখেছে আষ্টেপৃষ্ঠে। বৃষ্টি থেমে গেছে অনেকক্ষণ। পরিষ্কার মেঘমুক্ত আকাশে সুন্দর চাঁদ উঠেছে। চাঁদের দিকে তাকাতেই তার মনে পড়ে, আবিদ একবার বলেছিলো, “আকাশে চাঁদ যেদিন সুন্দর দেখবে, সেদিন তোমার সুন্দর দুটি চোখে কাজলের টান দিয়ে চাঁদের দিকে তাকাবে আর আমার কথা ভাববে।“
কথাটা হেয়ালী হলেও এখন যেন তমার জন্য তা-ই অনিবার্য হয়ে উঠলো। সে তার ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে লাইট জ্বালালো। বেশ কিছুটা সময় নিয়ে চোখে কাজল লাগায়। ঠোঁটে গাঢ় করে লিপস্টিক ঘষে। চুলগুলো সুন্দর করে আঁচড়ে বড় করে খোঁপা বাঁধে। তারপর আবিদের কথা ভাবতে ভাবতে বারান্দায় গিয়ে চাঁদের পানে মুখ তুলে তাকায়। আর তখনই হঠাত কোথাও লুকিয়ে থাকা দুষ্টু বৃষ্টি তার চোখের কাজল মুছে দিতেই যেন আড়াল থেকে ছুটে আসে ঝর ঝর করে।
(সমাপ্ত)

বৃষ্টি, সেদিনও ছিল

 

প্রায় আট ঘন্টা অবচেতন হয়ে পড়ে থাকার পর টিপু বুঝতে পারে সারা অন্ধকার যেন সূর্যের আগুন চোখ দেখে লুকিয়েছে। তারপরও মনে হচ্ছিল এইমাত্র শুয়েছিল সে। গতকালের ভ্রমনজনিত ক্লান্তি কাটিয়ে এখন বেশ ফুরফুরে লাগছে। গতকাল ভাবীদের এখানে আসতে তার নাভিশ্বাস উঠেছিল সত্যি কিন্তু এখন সেই সমস্ত দূর্ভোগের কারনে খারাপ লাগছে না। এখন আফসোস লাগছে ক্লান্তির কারনে অনেক কিছুই উপভোগ করা হয়নি।
ভাবীদের পুকুরপাড়ে দাড়িয়ে সকালে দাঁত ব্রাশ করছিলো টিপু। কেউ হয়ত পুকুরে মাছের খাদ্য দিয়েছিল আর অনেক মাছ ভেসেছিল সেই খাদ্য খেতে। ভাল লাগছিল বলেই মনোযোগ দিয়ে দেখছিল সে। “বীথি আপু ছেলেটি কে?” হঠাৎ দপ্তরির স্কুল ছুটির ঘন্টার মতো স্পষ্ট আর খৈ ফুটা শব্দের মতো মিষ্টি প্রশ্নে টিপুর মনোযোগ ততক্ষনে তাদের উপর পড়েলো কিন্তু তারা তাদের মতো ব্যস্ত। বিধাতা মানুষ সৃষ্টির সময় যে কারও কারও প্রতি একটু বেশি যত্নশীল ছিলেন, মেয়েটিকে দেখার আগে কখনো মনে হয়নি তার। সে একটা অদৃশ্য শক্তিতে সক্রিয় হয়ে উঠে। না, মেয়েটির প্রতি এই দূর্বলতাকে প্রশ্রয় দেয়া বোকামি। মেয়েটি বয়সে অনেক বড় হবে। এই সমাজ সংসার এখনও এমন হয়নি যে এটাকে সহজভাবে নিবে। মেয়েটির দিকে তাকিয়েই একা একা ভাবে সে। অবশ্য মেয়েটির মুখের দিকে তাকালে ষোল-সতরই মনে হয়।
ভাবী একদিন মমি বলে ডাক দিয়ে বলে দ্যাখ তোদের এখানে কাকে নিয়ে এসেছি। মেয়েটি বেরিয়ে এসে এমন স্বাভাবিকভাবে তাকালো, টিপুর মনে হলো সে কখনো অবাক হয়না, হবেওনা। কোন হিংসুটে চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি না থাকাতে তাদের মাঝে আত্নীয়তার যে একটা মধুর সম্পর্ক ছিল তা ক্রমেই বিকশিত হতে লাগলো। পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি দেহটাকে অর্থাৎ টিপুর নিজেকে কখনো বেটে বলে মনে হয়নি অথচ মমির সাথে পরিচিত হবার পর নিজের শ্যামলা বর্ণটাকেও অসহনীয় লাগছে। সতেরটি বসন্ত পাড়ি দেয়ার পরও চেহারা থেকে বালক বালক ছাপটা সরে যেতে অযথাই যেন বেশি সময় নিচ্ছে। মমিকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে চোখের ক্ষুধা মিটে না। চোখের তৃষ্ণা অনন্ত। মমির ফর্সা আঙ্গুলে টিপুর অসুন্দর আঙ্গুলগুলো বারবার লেগে যায় কখনো কেরাম কিংবা লুডু খেলতে গিয়ে। সেই ফর্সা আঙ্গুলগুলোকে হাতের মুঠোয় চেপে ধরার প্রচন্ড ইচ্ছে হয় টিপুর। মমির চুলে তেল দিতে গিয়ে দুধের স্বরের মত মসৃন পিঠে হাতের উল্টো পাশটা বারবার স্পর্শ করত সে কিন্তু কখনোই কারও কোন ভাবলেশ ছিলনা যেন অন্য দশটা আশরাফুল মাখলুকাতের মতো তাদের মানসিকতা এত সংকীর্ণ নয়। মমি একদিন সিগারেট টানবার আগ্রহ দেখায়। তারা নৌকা নিয়ে বিলের গভীরে চলে যায়, গা ঘেষে বসে। মমির টেনে দেয়া সিগারেট টানবে বলে টিপু একটি সিগারেট ধরায় যেন মমির টেনে দেয়া সিগারেটে অমৃত থাকবে। মমি সাবলীলভাবে মদ্যপ রমনীর মত সিগারেট টানে, ধোয়া ছাড়ে। তাকে কেমন জানি রহস্যময়ী লাগে। সে টিপুর মুখে সিগারেটের ধোয়া ছাড়ে। মমির গভীর দৃষ্টি, ঠোঁটে ক্ষুদ্র হাসির মর্মার্থ যেন বুঝতে পারে টিপু তাই সুযোগটা হাতছাড়া করেনা সে। খুব কাছ থেকে মমির মূখে, গলায় ধোঁয়া ছাড়ে টিপু। সহসাই দুটি নরম হাতের ধাক্কায় পানিতে ছিটকে পড়ে সে। মমির মাংসল বাহুদ্বয়কে টিপুর হাতের আঙ্গুলগুলি আকড়ে ধরে।
- ফেলে দিই? মমির চোখে তৃষ্ণার্ত দৃষ্টি রেখে বলে টিপু।
- প্লিজ আমাকে ভিজিও না। আর্তি জানায় মমি। কিন্তু তার কণ্ঠের স্বরটা যেন বলছে “আমাকে ভিজিয়ে দাও”।
পাউরুটির মত নরম বাহুতে আঙ্গুলগুলোর বেশিক্ষন ডুবে থাকার লোভে টিপুর বিলম্ব হয়  তাকে পানিতে ফেলতে। মমি যখন পানি থেকে উঠে তখন টিপুর মনে হয় যেন নৌকায় জলপরী উঠেছে। ভিজে চুপচুপে গোলাপী জামাটা যতই তার ভিজে যাওয়া সৌন্দর্যকে পৃথিবীর লোলুপ দৃষ্টির ঝড়-তুফানের হাত থেকে বাঁচাতে প্রাণপণ চেষ্টা করছিল ততই ফুটে উঠছিলো গোলাপ কলির মতো, থোকা থোকা আঙ্গুর আম গাছে ঝুলে থাকার মতো। সৌন্দর্যের বসন্তে মমির পুষ্ট বুক, ভারী নিতম্ব কোন কিছুই দৃষ্টি এড়ায় না। তথাপি সে নির্বিকার, সে আগুয়ান। ঊনিশটি ক্যালেন্ডারের পাতা ধরে ঝুলে থাকা এই তরুনীকে বাইরে থেকে যতই উচ্ছল ও দৃঢ় বলে মনে হয়, আসলে সে ক্লান্ত, হতাশায় নিমজ্জিত। ঝুলে থেকে থেকে তার হাত ছিড়ে যাবার যোগাড়। তাই হয়ত আত্নফাটা হাহাকারে সে আগমন কামনা করছে কোন এক দ্বিগিজয়ীর। যে এখান থেকে তাকে উদ্ধার করে নামিয়ে দিবে কোন এক স্বর্গপূরীতে। গলা সমান পানিতে দাড়িয়ে থেকে টিপুর চোখে তার দৈন্যদশা সূর্যের আলোর মতোন স্পষ্ট হয়ে উঠে।
কিছুতেই ঘুম আসতে চাইছে না টিপুর। বিছানাকে শুন্য উদ্যান মনে হচ্ছে। কখনোই এমন তীব্র একাকীত্ব সে অনুভব করেনি। মমিকে বারবার মনে পড়ছে। নানা ভাবনা মাথায় জটলা পাকাচ্ছে। মমিও কি এমন ছটফট করে? সেও কি নানা অজুহাতে তাকে স্পর্শ করে? নইলে জ্যোতিষির মত তার হাত দেখে বানিয়ে বানিয়ে এটা সেটা বলতো সে জেনেও কেন হাত ধরে থাকতে দিয়েছে? কেনইবা তার হাত উরুতে রেখে নেইলপলিশ দিয়ে দিয়েছে? সেরকম মনোবৃত্তি থাকলে তো সে অনায়াসেই পারতো। তবে কি জানাজানি হয়ে বদনাম হয়ে যাবার ভয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে?
পরদিন যখন মমির মা ভাবীদের ওখানে গল্পে মত্ত। বাবা বাড়িতে নেই, ছোট ভাইও স্কুলে। মমি ঘুমিয়ে আছে। বাঁধাহীন দৃষ্টি দিয়ে মমিকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে টিপু। মমির ঠোঁটকে পিপার্সাত মনে হয়। মমির নাকে, মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। সেই ঘামে টিপুর রুক্ষ ঠোঁটকে ভেজাবার ভাবনা মনে আসে কিন্তু মনে হচ্ছে লোমের স্পর্শেও সে জেগে যাবে। হঠাৎ কেউ যেন উত্যক্ত করে বলল টিপুকে এই নারী কখনো তোমার হবে না, তোমায় মনে রাখবে না, সে অন্য কারও ঘরণী হবে। অন্য কেউ তার…..। বানের পানি চলে গেলে দূর্বাঘাসের যে অবস্থা হয় টিপুর অবস্থাও সেরকম হলো। মমি কখনোই তার হবে না, তাকে মনে রাখবে না, অন্য কেউ তার…..। মন কিছুতেই মেনে নিতে পারল না। টিপুর ইচ্ছে করল মমিকে জড়িয়ে ধরে তার হৃদয়ে চিরস্থায়ী অস্তিত্বের বীজ বপন করতে। সে অন্তঃত এই ভেবে তাকে মনে রাখবে। একটি নারীর যে সৌন্দর্য দেখে পুরুষ মুগ্ধ হয়, মুখে লালা আসে, সেই সৌন্দর্যের দীঘিতে এই পিচ্ছি ছেলেটা প্রথম দক্ষ ডুবুরীর মত তন্ন তন্ন করে রত্ন খুজেছে এবং খুজে পাওয়ায় সে গর্বিত। টিপু ভাবে, জড়িয়ে ধরলে সে কি করবে? হয়ত সে ঝটকা দিয়ে দুরে সরিয়ে দিতে পারে, ঘৃণায় মুখে থুথু দিতে পারে। আবার এমনও হতে পারে সেও জড়িয়ে ধরতে পারে আক্রোশতায়। যার দেহে এত আহবান সে কিভাবে ফিরিয়ে দিবে? টিপুর মনে হলো তার জীবনের সমস্ত স্বার্থকতা ব্যর্থতা পাশাপাশি দাড়িয়ে। সে যাই ভাবুক তাকে স্বার্থক হতেই হবে। তবুও কেন জানি স্পর্ধার বাধ ভাঙতে চায় না। অবস্থাটা যেন ঘুমন্ত বাঘের সামনে পা টিপে টিপে চলা। বাঘের ঘুম ভাঙ্গলে রক্ষা নেই তবুও বাঘের সৌন্দর্যকে হাত বুলিয়ে দেখার ইচ্ছে। অবশেষে বুকে দুঃসাহস সঞ্চয় করে টিপু মমির ঠোঁটে আঙ্গুল স্পর্শ করে। মমির ঘুম ভাঙ্গে না। মনে হয় মমির ঠোঁটযুগল যেন আঙ্গুলগুলিকে সোহাগ করছে। তারপর টিপু নিজের ঠোঁট মমির ঠোঁটে স্থাপন করতেই সে চমকে গিয়ে বিছানায় বসে পড়ে। টানটান বুকের পাহাড়ে পর্দা দেয়। তাকে দেখে রাগান্বিত মনে হয়। টিপু হতভম্ব। লজ্জায়, অপরাধবোধ এবং একইসাথে অনুশোচনায় চলে আসতে আসতে উপলব্ধি করে, অন্যের গাছের চুরি করা ফল খেয়ে যতই তৃপ্ত হওয়া যায় না কেন, কোন নারীকে সাধু সেজে চুরি করে স্পর্শ করে কোনই তৃপ্তি নেই বরং হিতে বিপরীত হয়। তারচেয়ে বরং স্পর্শের সময় সংকীর্ণ মানসিকতা প্রকাশ পেলেই হয়ত অনেকটা তৃপ্তি পাওয়া যায়।
পরদিন বিলপাড়ের মেঠো পথে দুজন হাটছিল। উন্মাদ হাওয়া বারবার মমির পর্দা এলোমেলো করে দিচ্ছিল। মমি অসস্তি বোধ করে টানটান বুকে বারবার পর্দা দিতে। টিপু ভাবে এমন রুপবতীর হৃদয়ের ঝরণায় স্নান তো দুরের কথা সেখান থেকে সামান্য জলের ঝাপটাও সে মুখে দিতে পারবেনা। তার হতাশাগ্রস্থ মন আপনমনে বলে, মমিকে যদি না পাই তবে জীবনে পাওয়ার থাকলো কি? নীরব প্রকৃতির সাথে তাল মিলিয়ে তারা দুজনেই নীরব। টিপু কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। বহু কষ্টে কথা বেরুল,
- শুনলাম, আপনি বিয়েতে রাজি হননা, কেন? মমি টিপুর দিকে একবার তাকিয়ে ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে একটানা বলতে লাগলো,
- বিয়ে একটি নারীর জীবনে খুবই কাংখিত দিন। সে দিনের আশায় মেয়েরা ছটফট করে। আমার মনে হয় সে রাতে তাদের প্রায় সবাই ধর্ষিতা হয়। কয়েকটা কথার বদৌলতে স্বামী বনে যাওয়া পুরুষটা দেনমোহর সংক্রান্ত কয়েকটা কথা বলে কিংবা না বলে ক্ষুধার্ত প্রাণীর মতো তাজা মাংস পেয়ে সারা জীবনের ক্ষুধা মেটায়। তার ভাললাগা, মন্দলাগা, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, মানসিকতায় কোন আগ্রহ নেই। সে তার স্বামী। স্ত্রীর দেহে কর্তৃতের একমাত্র অধিকারী। প্রশ্রয় দিলে মাথায় উঠবে তাই সে নির্মম। আসলে তারা কোন মেয়েকে বিবাহ করে না। বিবাহের উদ্দেশ্য দেহ। এসবের জন্যই এতে আমার বিতৃষ্ণা ধরে গেছে।
টিপু ততক্ষনে একটু স্বাভাবিক।
- বিয়ের আগে কথা বলে ছেলের মানসিকতা যাচাই করে নিতে পারেন না? একটু ইতস্তত করে আবার বলে সে।
- কয়েকটা মূহুর্তে একটা মানুষকে কতটুকু জানা যায়? আমাকে পাওয়ার জন্য সে চাতুরীর আশ্রয়ও নিতে পারে। বলেই টিপুর দিকে তাকায় মমি।
- সবাইতো আর একরকম না। মাটির দিকেই তাকিয়ে বলে টিপু। মমি আবারো বলতে থাকে,
- সব পুরুষই যেন ভিন্ন ভিন্ন চেহারায় একই রুপ। তাদের সাথে কথা বলাটাই যেন দোষের। দু’একদিন ভালভাবে কথা বললেই পরের দিন যত্রতত্র প্রসংশা হাতে গুজে দিবে। আমার ড্রয়ারে এরকম অনেক প্রসংশাপত্র পড়ে আছে। সেগুলো পড়লে তাদের কুকুরের মত জিভটা চোখের সামনে দেখতে পাই। টিপু এবার মমির চোখের দিকে তাকিয়েই বলে,
- এটাই তো স্বাভাবিক। যদি একটি পাত্রে কতগুলো ফল সাজিয়ে রাখা হয় এবং সবার জন্য বরাদ্ধকৃত একটি ফল নিতে বলা হয় তবে সবাইতো চাইবে সবচেয়ে ভাল ফলটাকে বেছে নিতে। তেমনি সুন্দরী নারীর স্বামী হবার প্রয়াসে তারা একটু তাড়হুড়ো করে অথবা আপানার ভাষায় চাতুরীর আশ্রয় নেয়। মমি কিছুক্ষন নীরব থেকে বলে,
- আমি জানি কিন্তু আর পাঁচ সাতটা মেয়ের মত আমি নই, উন্মাদনার মধ্যে জীবনের সকল মর্ম খুজি না। আমি চাই এমন একজন স্বামী যে আমাকে নিয়ে পাখির মতো আকাশে উড়ার স্বপ্ন দেখবে, হাঁসের মতো পুকুরে সাঁতরাতে চাইবে। শুধু দেহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। আবার কিছুক্ষণ নীরব থেকে দৃষ্টি একদিকে রেখে মমি বলল,
- দু’একজনকে যে ভাল লাগেনি তা নয়। কিন্তু মন কখনোই তাদের কামনা-বাসনার লোভকে মেনে নিতে পারে না। তাই নিজের রুপটাকে মাঝে মাঝে অভিশাপ মনে হয়। আচ্ছা বাদ দাও তো। তুমি কাল কখন চলে যাবে? টিপু কিছু বলতে পারে না। মমির দূর্দান্ত মিষ্টি মুখে বেদনা ভেসে বেড়াচ্ছে। তাকে প্রেম কাতর মনে হয় টিপুর।
- তুমিতো কাল চলে যাবে, আমাকে মনে থাকবে তো? আবারো হেসে হেসে বলে মমি।
- আমার ঠিকই মনে থাকবে, আপনারই থাকবে না। কিছুটা অভিমানের স্বরে বলে টিপু।
- বিশ্বাস কর টিপু, তোমায় কখনো ভুলবো না। খুব মিস করবো। টিপুর হাত ধরে অনেকটা অনুরোধের স্বরে আবারো বলে,
- যতক্ষন আছো, বাকী সময়টা আমরা উপভোগ করতে পারি না? রাতে এসো পুকুরের দক্ষিণ পার্শ্বের আমগাছ তলায়।
- কেন? টিপুর মুখ ফসকে বেরিয়ে আসে হঠাৎ।
- ভীরু কোথাকার। ভাজা মাছটিও উল্টিয়ে দিতে হবে? বলেই লজ্জামিশ্রিত অদ্ভুদ মুখভঙ্গি করে ঠোঁটে এক টুকরা হাসি ফুটিয়ে পালিয়ে যায় মমি। স্ট্যাচুর মতো দাড়িয়ে থেকে টিপু মমির চলে যাওয়া দেখে শুধু।
সন্ধ্যা থেকেই বৃষ্টি ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বন্ধ হওয়ার নমুনাও দেখা যাচ্ছে না। টিপুর অসহ্য লাগছে। ঘর থেকে বের হতে পারছে না। বারবারই কানের কাছে ফিসফিস করে কে যেন বলছে “ভাজা মাছটিও উল্টিয়ে দিতে হবে?” আবার টিনের চালে বৃষ্টি পড়া শব্দের সাথে মিলিয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতির এ নির্মমতা সহ্য হচ্ছেনা কিছুতেই। মমিও কি তার মতো তবে অসম প্রেমে জড়িয়ে গেছে? যদি গিয়েই থাকে তবে এর পরিণাম কি? তারা দুজন দুজনকে কতটুকুই বা বুঝেছে? কাল সকালেই তো চলে যেতে হবে। আর কখনো কি দেখা হবে মমির সাথে? এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে টিপু ঘুমিয়ে পড়ল।
প্রায় মাসখানেক হলো টিপু নিজের বাড়ীতে আসার পর সারাক্ষণই আনমনা, একটু গম্ভীর ধরনের। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে বুক থেকে চাপা কোন পাথর সরে গেছে। কারন মমির চিঠি এসেছে। একরকম ভয়, সংকোচ এবং আনন্দ নিয়ে সে খামটা খুললো। গোছানো হাতের লিখা বেশ স্পষ্ট ও সুন্দর,
টিপু,
ভালো আছ নিশ্চয়ই। থাকাটা স্বাভাবিক কারণ মমি নামের কেউ তো এখন যখন তখন এখানে সেখানে যাওয়ার জন্যে বায়না ধরছে না। তুমি যাই বলো সত্যি বলতে ভালোই কেটেছে সময় ক’দিন। তোমার কি মনে হয়? যাই হোক, তুমি চলে যাওয়ার আগের দিন তোমার সাথে কথা বলে নিজেকে খুব অসহায় লাগছিল। এই সত্যি উপলব্ধি করেছি যে, সমাজ সংসারে স্বাভাবিক রীতিটাকে অস্বীকার করাটা বোকামী। কোন অপছন্দ বিষয় যেটা সামাজিকভাবে স্বীকৃত, মেনে নেয়াটাই বরং শ্রেয় এবং তাই হয়তো আমি আমার মানসিকতা বদলে দিয়েছি। যে জন্য তোমাকে লিখছি, আমি বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং আগামী মাসের তিন তারিখ বিয়ে। বিস্তারিত সাক্ষাতে। তুমি অবশ্যই আসবে। সে পর্যন্ত ভালো থেকো।
ইতি,
মমি।
টিপুর বুক থেকে একটু আগে পাথরটা সরে যাওয়ায় তাকে যেমন উচ্ছল মনে হচ্ছিল মূহুর্তেই সে জায়গাটায় বিরাট শুন্যতা অনুভব করলো। বুকভরা হাহাকার নিয়ে আকাশের দিকে তাকালো টিপু। আকাশে ঘন মেঘ জমেছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। মনে হয় কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি নামবে। হঠাৎ টিপুর মনে হলো বৃষ্টি, সেদিনও ছিল।

 

এক নিস্তব্ধ ভালবাসা

 

অনবরত মুঠোফোনটা বেজেই চলেছে, দৃষ্টি আকর্ষণের বৃথা প্রচেষ্টা। একজন দুজন নয়। বহু মানুষ স্মরণ করছে ওকে। শুভেচ্ছা বার্তা ও পেয়েছে, নিছক কম নয় তার পরিমাণ ও। আজ ঈদ এর দিন। কোন ভ্রূক্ষেপ ই নেই ওর। সকালে ঈদ এর নামাযটায় ও অনুপস্থিতি। গায়ে দেয়া হয়নি প্রিয় মানুষটির দেয়া নীল পাঞ্জাবীটি। ঘুমহীন টলটলে দুটো চোখ, অনিয়মে বেড়ে ওঠা মাথা ভরা উস্কখুস্ক অগোছালো চুল আর নিথর দেহটা দেয়ালে ঠেকিয়ে দৃষ্টি মেলে আছে জানালা গলে বাহিরে। রোদেলা আকাশে মেঘ জমেছে, মেঘের আড়াল দিয়ে সূর্যের উজ্জ্বলতা জাহিরের তীব্র প্রচেষ্টা দেখতে খারাপ লাগছেনা আজ।
এক দুবার হয়তো চোখের পাতা ফেলেছিল, এর ই মাঝে এক পসলা বৃষ্টি যে কখন ঝরে পড়ল সেই সময়টি ও দেখা হয়নি আজ। মেঘরাজ বিদায় নিয়েছে, সূর্যের আলোতে জলে ভেজা নারিকেলের পাতাগুলোতে কে যেন মুক্ত গেঁথে রেখেছে। হঠাৎ করেই কোত্থেকে জানি এক বৃষ্টিভেজা শালিক এসে বসলো পাতার উপর আর শুরু করলো জল ঝারবার কসরত। এক শালিক দেখে আজ ও একটু ও বিচলিত নয়। কিভাবে হবে! একা একা তো ঝগড়া হয়না।
সম্বিত ফিরে পেল রুদ্র ছোট ভাইটার করা অনাকাঙ্ক্ষিত এক প্রশ্নে। ও যে কখন ঘরে ঢুকেছে খেয়াল ই করেনি। “ভাইয়া, তুমি কি গোঁফ দাঁড়ি করছ?” সহজ সরল প্রশ্নটা শুনে এক গাল হাসল রুদ্র। পাশের কক্ষ থেকে মা শুধরে দিল, “গাধা। গোঁফ দাঁড়ি করতে হয়না, রাখতে হয়।” হয়তো নিজের অজ্ঞতার লজ্জায় ছোট মানুষটা আর দাড়ালোনা ঘরে, অন্য ঘরে চলে গেল।
রুদ্রর হাতে আজ অনেক সময়। আজকের দিনটার কোন প্রভাব নেই ওর মনে। নেই কোন পরিকল্পনা। জীবনের নিদারুণ বিড়ম্বনায় আজ অনেক বেশি আহত সে। দেয়ালে ঝুলানো যান্ত্রিক পাখাটার দিকে তাকিয়ে সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করে দেয় কিন্তু যদি জিজ্ঞাসা করা হয় পাখাটা কোনদিকে ঘুরছে, হয়তো বলবে, “কই! খেয়াল করিনি তো!” আজ রুদ্র বড্ড এলোমেলো। ওর জীবন বধ করা হয়েছে, মনের মানুষটা তার কাছে শুনতে চায়না আর ভালবাসার গল্প।
ঈদ এর বিকেল। সবাই বেরিয়েছে ঘুরতে। হ্যাঁ। সবাই। শূন্য দৃষ্টি মেলে সামনে চেয়ে আছে রুদ্র। সূর্যের হলদেটে আভা চারিদিকে ছড়িয়ে আছে। আবার শুরু হল বৃষ্টি, ক্ষণিকের জন্য। রুদ্রর মনে পরে গেল সেই দিনটির কথা, যেদিন এই বর্ষার প্রথম কদম ফুলটি তার হাতে তুলে দেয়ার ভূত ঘাড়ে চেপেছিল।
নাহ… কোন ফুলের দোকান ঘুরে ফুল পাওয়া যায়নি। রাজপথে ফুল হাতে ছুটে আসা ক্ষুদ্র বিক্রেতাও ফুল এর সন্ধান দিতে পারেনি। সারা সকাল দুপুর বহু এলাকা ঘুরেছে, কদম ফুলগাছও পেয়েছে কিন্তু একটা ফোঁটা ফুলও যে পাইনি। গোল গোল সবুজ ফুলগুলো যেন ওর দিকে চেয়ে রসিকতা করেই দুলছিল। অবশেষে পথ চলতে চলতেই দেখল এক পথশিশু কদমফুল ছিড়ে ছিড়ে পথে ফেলছে। হুড়মুড় করে রিকশা থেকে নেমে ছুটে গেলো ছেলেটার কাছে। বাচ্চাটার হাতে দেখল মাত্র একটা আধা ছেড়া ফুল। জিজ্ঞাসা করলো ফুলগাছ কোথায়। প্রত্তুতরে ছেলেটা জানাল, “ভাই। ফুল তো জালায় নাই।” মানে, ফুল তো ফোটে নাই। আশা হারালোনা। ছেলেটাকে সাথে নিয়েই খুঁজে বের করলো কদম ফুলগাছ। প্রস্ফুটিত কিছু ফুল দেখে খুব খুশি হল রুদ্র।
এরপর শুরু হল আরেক পরীক্ষা। গাছে উঠতে পারেনা রুদ্র। আশেপাশে তেমন কাউ কে পেলনা। কিন্তু ফুল তো যেভাবেই হোক লাগবেই। বহু কসরত করে কিছুদূর উঠল। এরপর একটা লাঠি আর ওর মাঝারিকার দেহটা কাজে লাগিয়ে বহু ভঙ্গিমায় কিছু ফুল পাড়ল। ফুলগুলো একত্র করে শুরু করলো আবার পথচলা। সারাটা দিন খাঁ খাঁ রোদ ছিল। তৃষ্ণা পেয়েছে টের পেল। দু বোতল পানি কিনল। একটা নিজে পান করলো আরেকটা থেকে মাঝে মাঝেই ঠাণ্ডা পানি ঢালল ফুলের ওপর। পাছে ভয় হয়, এই গরমে ফুলগুলো যদি মিইয়ে যায়। একটা বার ও হাত থেকে কোথাও রাখলনা কারণ চোট পেলে ফুলের পাপড়ি গুলো বসে যেতে পারে।
এভাবেই পৌঁছল গন্তব্যে। তখন সন্ধ্যা। কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেনা কিভাবে দিবে ফুলগুলো ওর হাতে। ততক্ষণে ফুলগুলো মিইয়ে গেছে। আর দেরি না করে মন মানুষটিকে ডাক দিয়ে হাতে ধরিয়ে দিল ফুলগুলো। কিভাবে দিতে হয় রুদ্র জানতোনা। অপরিণত মস্তিষ্কের পাগলামির এই অঘোষিত প্রচেষ্টা পরিণতি পেল। মনের মানুষটার মুখে এক ঝলক হাসির দেখা সে পেল। মানুষটি বলল, “আমার জন্য কেউ কখনো এমন করেনি।” রুদ্রর মনে হল, এতটুকুই তো সব, আর কিছু চাইনা জীবনে। সারাদিনের অভিযানের পর এক সুখী মানুষের তৃপ্ত হৃদয় নিয়ে রুদ্র ঘরে ফিরল।
রুদ্র আজ নিশ্চুপ। দুনিয়ার গড়া তথাকথিত সমীকরণে ওকে ফেলা হয়েছে আজ। আর দশটা হীনচেতা মানুষের সারিতে ওকে দাড় করানো হয়েছে আজ। অপরাধ টা কি? রুদ্র জানেনা। হয়তো ওর পাগলের মত অস্বাভাবিক ভালবাসা আজ মানুষের কাছে দৃষ্টিকটু। হয়তো ওকে আজ বিশ্বাস করতে পারেনা মানুষটি। রুদ্র জানেনা কিভাবে প্রমাণ দিবে। এইত গতদিন ও রুদ্র নিকষ আঁধার দেখে ফিরেছে, একটুও দ্বিধা করেনি এইভেবে যে মানুষটা হয়তো সুখে থাকবে ও সরে গেলে। এর থেকে বেশি কিছু রুদ্রর জানা ছিলোনা।
দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। দূরের দৃশ্যপট গুলো আর দেখা যাচ্ছেনা। রুদ্র বুঝল সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এর ই মাঝে মা কয়েকবার এসে খেতে বলে গেছে। লাভ হয়নি। জোর করে কিছু খাইয়ে দিয়েছে, রুদ্র টের পায়নি। এখন মুখটা মিষ্টি লাগছে, হয়তো পায়েস ছিল জিনিসটা।
এখন রাত। ঈদ এর দিনটি প্রায় শেষ। গানের গলা ভালোনা রুদ্রর। মনের মানুষটিকে তাই গান শোনাতে পারেনা সে। কিন্তু এখন সে গাইছে, ভয় কি! কেউ তো আর শুনবেনা। গলা ছেড়ে গান গাইছে রুদ্র। চোখের জল গাল গড়িয়ে পরছে। কাঁপা কাঁপা ভাঙ্গা গলায় তারপরেও সে গাইছে।
বহু নামে ডাকতো রুদ্র তার মনের মানুষটিকে। বহু নামে। সব গুনলে হয়তো কয়েক ডজন হবে। আজ ডাকতে পারেনা। ওর উপর আজ মনঃমানুষটির নিষেধাজ্ঞা আরোপিত। রুদ্রর খুব কষ্ট হয়। নীল বেদনায় ছটফট করে বিছানায়। আজ ওকে দেখবার কেউ নেই। রুদ্র আজ অনেক একা। ওর চারপাশের জীবনগুলো আপন গতিতেই চলছে, ওকে নিয়ে কোন পরিকল্পনা হবেনা, ওর জন্য কেউ সাজবেনা, সামনে দাড়িয়ে বলবেনা, “দেখো তো আমায় কেমন লাগছে!”, এভাবেই চলতে থাকবে সবকটি মানুষের পৃথিবী। থেমে থাকবে রুদ্রর মতো কিছু মানুষের জীবন। হয়তো সে একটু আলাদা, হয়তো মানুষ না। আজ ও নিজেকে বড্ড ভয় পায়, যেমন টা আগে ছিলোনা।
===== ঈদ এর আগের দিন =====
পিটপিট করে চোখ মেলে নিজেকে খুঁজে পায় রুদ্র হাসপাতালের ICU এ। বিরক্তি ভরা চোখে চারদিক দেখতে থাকে। তার তো এখানে থাকার কথা না। তাহলে কি কোথাও গড়মিল হল!!! লজ্জায় মুষড়ে পড়ে রুদ্র। এত ছোট কাজটাও সে ঠিকমত করতে পারলনা। তার মা সময়মতই তাকে ধরে এখানে এনেছেন। এক নিদারুণ লজ্জা আর ঘৃণা অনুভব করলো নিজের প্রতি।
=====================
ঈদ এর দিনরাত উভয়ই পরিসমাপ্তির পথে। রুদ্র এখনো ভালবাসে তার মনের মানুষটিকে, হয়তো আগের থেকে আরও বেশি। কিন্তু আজ ও বলতে পারেনা, নাম ধরে ডাকতে পারেনা, আগের মত করে হাসতে পারেনা। একটা আশা নিয়ে এখনো বেঁচে আছে সে। হয়তো ওর মানুষটি একদিন বুঝবে ওকে, তারপর ওকে শেখাবে কিভাবে হাসতে হয়, কিভাবে ভালবাসতে হয়।
রাত খুব বেশি না। তাতে কি! রুদ্র এখন ঘুমাবে…
======================
অগোছালো লাগছে ঘটনাগুলো! আসলে গল্প আর মানুষের জীবনের মাঝে এই একটাই তফাৎ, জীবনে সবকিছু গল্পের মত সুন্দর করে সুবিন্যস্ত ভাবে ঘটেনা। এক রুদ্রের এক জীবনের এক টুকরো বাস্তবতা এখানে। আপনাকে যদি শিহরিত না করে, না হাসায়, না কাঁদায় তাতে রুদ্রর জীবনের কিছু যায় আসবেনা। যদি ওর জীবন থেকে আপনি ভালবাসা শিখতে পারেন, এটাই হবে ওর এলোমেলো জীবনের সার্থকতা।

(সংগৃহীত)

 

আমি তোমার মনের ভিতর

“আগে জানলে, তোমাকে বিয়েই করতাম না।“
“কি জানলে?”
“এই মেজাজ আর এই চেহারা ওয়ালা মেয়েকে পাগল ছাড়া আর কেও বিয়ে করে?”
“তা হলে প্রেমে পড়ে মজনু হয়েছিলে কেন? আবার যে দুই বার স্যুইসাইট করতে নিয়েছিলেন জনাব। সেই কথা নতুন করে মনে করে করিয়ে দিতে হবে না-কি?”
“সেই মেয়ে তো আর এখনকার তুমি না?”
“দেখ বেশী মাথা গরম করিয়ে দিও না। তুমি যেই অহনার প্রেমে পড়ে দিওয়ানা হয়েছিলে, সে ছিল আমার বাবার আদরের দুলালী। অনেক আদর-যত্নে বড় করেছিল। আর সেই আদরের দুলালীকে দিনে দিনে ধবংস করে তুমি আজকের অহনাকে বানিয়েছ”।
“কি বললে, আমি তোমাকে ধবংস করেছি। ঠিক আছে যাও বাবার বাড়ি যেয়ে আলালের ঘরে দুলালী হয়ে থাক যেয়ে।“
“কি, কি বললে? আমাকে বাসা থেকে বের হয়ে যেতে বলছ?”
“তা বলবো কেন?  তুমিই তো বললে আমি তোমাকে ধবংস করে দিয়েছি।”
“ঠিক আছে, আমি আজকেই চলে যাব।”
ব্যাস আরম্ভ হয়ে গেল, পারিবারিক তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধের আরেক পর্ব। একেবারে সম্মুখ যুদ্ধ।
প্রতিপক্ষ দুই নিয়মিত পরাশক্তি অহনা আর কাজল।

দুই পক্ষের শান্তিকালীন সময় বেশী দিন স্থায়ী হল না। এর আগের বড় যুদ্ধের পরে অহনা চলে গিয়েছিল বাবার বাসায়। যাবার সময় বলে গিয়েছিল, চল্লিশ দিনের মধ্যে দ্বিতীয় বিবাহ করে দেখিয়ে দিবে। কিন্তু ঘটনাক্রমে আকাশের মেঘ তাদের বাঁচিয়ে দিল। অহনা অন লাইন ম্যাচিং সার্ভিসকে বললো, তার এমন ছেলের দরকার, যে ছেলে মেঘের সাথে কথা বলতে পারে। শেষে দেখা গেল, কাজলই এক মাত্র সে রকম ছেলে, যে মেঘের কথা বুঝে। তার পরে দু জনের মিলমিশ হয়ে গেল।
তিন মাসের মধ্যেই প্রথম সংঘর্ষ লাগলো। অহনা এখন কম্পিউটারে বেশী সময় কাটায়। ফেসবুক, ই-মেল, ফার্ম ভিল আর কত কি। কাজল প্রথমে অবাক হল। যে মেয়ে মাত্র কয়েক দিন আগে পর্যন্ত কম্পিউটারের আশে পাশে পর্যন্ত যেত না, সে এখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাচ্ছে সেখানে। আড়িপেতে দেখল, বিষয়টা কি? যে রকম সন্দেহ, অনেকটা সে রকম আবিষ্কার করলো। এখনো অহনাকে অন লাইন ম্যাচিং সার্ভিস থেকে ঠিকানা পাওয়া ছেলেরা ইমেল করছে। অহনা ওদের উত্তর দিচ্ছে। কেও কেও আবার ফেসবুকের বন্ধু পর্যন্ত হয়েছে। ব্যাপারটা ভাবতেই কাজলের শরীরটা রি রি করে উঠলো।  কে জানি বলেছিল, মেয়েদের ভালবাসা নদীর মত। তা শুধু বহেই যায়।  অহনার ভালবাসা কি কাজলকে ছাড়িয়ে চলে গেছে অনেক দূর! এ গুলো ভাবতেই কাজলের মাথা ঝিম ঝিম করতে লাগলো। কিছু একটা প্রচণ্ড শব্দ করে ভেঙ্গে ফেলতে পারলে খুব ভাল হত।
অহনা দেখল, বাড়ি ফিরে আসার পরে, প্রথম কয়েক দিন কাজল তাকে খুব মনযোগ দিল। সাথে সাথে থাকা, বেড়াতে যাওয়া,  গল্প করা, সুযোগ পেলেই হাত ধরে বসে থাকা আর কত কি। কয়েক বার ছাদে যেয়ে মেঘের সাথে কথা পর্যন্ত তারা বলেছে। ঠিক সে-ই প্রেম করার দিনগুলোর মত। কিন্তু কাজল আবার আগের চেহারা পেতে থাকলো। ছুটির দিনে দেরী করে ঘুম উঠা, খাবার টেবিলে বসে মোবাইলে বন্ধুদের সাথে কথা বলা। অহনার সব কথা ভুলে যাওয়া রোগটা কাজলের ফিরে আসলো। মামাকে জাপানে চিঠিটা পোস্ট করেছ, গ্যাসের বিল দিয়েছ, কলের পানি বন্ধ হচ্ছে না, সারা দিন টিপ টিপ করে পড়ছে, মিস্ত্রিকে ডেকেছ?——– এ রকম সব প্রশ্নের উত্তর কাজল কি দিবে, অহনার একেবারে তা জানা। ‘মনে ছিল না, ভুলে গেছি’। অহনা  গজ গজ করতে থাকে, সব কাজই যখন ভুলে যাও, তখন বিয়ে করার কথাটা মনে রেখেছিলে কি করে।  এ রকম লোকের সাথে আর যাই হোক ঘর করাটা মুশকিল।

দুই পক্ষের কথা বার্তা বিভিন্ন মেয়াদের জন্যে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে অসহযোগ আন্দোলন হচ্ছে। এর মধ্যে কয়েকবার অনশন ধর্মঘট পর্যন্ত হয়েছে। কিন্তু কোন আন্দোলনের ফলাফল দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে না। যখনই এক পক্ষের মনে হচ্ছে বেশী ছাড় দেয়া হয়ে গেছে, তখনই আবার নতুন করে আক্রমন করা হচ্ছে। দুই পক্ষই কোন নতুন সুযোগ হাত ছাড়া করতে রাজী না।
এ রকম কঠিন অবস্থার মধ্যে প্রকৃতির আরও কিছু রসিকতা করার ইচ্ছে হল। ঘুমের মধ্যে এ পাশ ওপাশ করতে কাজল সশব্দে নাক ডাকার অভিষেক করলো। অহনা ধাক্কা দিয়ে কাজলকে এপাশ থেকে ওপাশ করলে, মিনিট পাঁচেকের জন্যে নাক ডাকা বন্ধ থাকলো। তার পরে আবার নতুন উদ্যমে আরম্ভ হল।  বেচারা অহনার ঘুম হারাম হয়ে গেল। মানুষ আবার এত জোরে নাক ডাকে ন-কি!
অহনা প্রথমে কয়েক দিন সহ্য করার চেষ্টা করলো। ভাবল তুলির মত অভ্যাস হয়ে যাবে। তুলি একবার গল্প করেছিল, তার স্বামীও একবার হঠাৎ করে ঘুমের মধ্যে নাক ডাকা আরম্ভ করলো। কয়েক দিন সমস্যা হলেও, তুলির এখন নাক ডাকার শব্দ শুনতে ভালই লাগে। কেমন একটা ঘুম পাড়ানির গানের মত মনে হয়। কিন্তু অহনার বেলায় হল ঠিক উল্টো। রাতের বেশীর ভাগ সময় না ঘুমিয়ে কাটাতে হলো।
অনেকটা বাধ্য হয়ে, অহনা বেশ মিষ্টি করে বলল, তুমি কি একটু ডাক্তার চাচার সাথে দেখা করতে পার? কথাটা শুনে কাজল ভাবল, নিশ্চয়ই অহনার কোন সমস্যা হয়েছে। দুর্বল প্রতিপক্ষের সাথে তো আর যুদ্ধ করা চলে না। মনে মনেই ‘সিস ফায়ার’ ঘোষণা করলো। এখন থেকে যুদ্ধ বিরতি কিংবা যুদ্ধ একেবারে বন্ধ। জানতে চাইলো, কেন, কেন ডাক্তার চাচাকে কি বলতে হবে?
অহনা খুব নরম করে বলল, যেয়ে বল, তুমি ঘুমালে ভীষণ নাক ডাকছ, আমি ঘুমাতে পারছি না। এর জন্যে তোমাকে ওষুধ দিতে। কাজল ধরে নিল, তাকে ছোট করার জন্যে এইটা অহনার অবশ্যই নতুন একটা কৌশল। বেশ জোরেই উত্তর দিল, আমি নাক ডাকি আর আমি জানি না। আর উনি শুনতে পান। কাজল ‘সিস ফায়ার’ উঠিয়ে নিয়ে একটা নোংরা ধরনের অস্ত্র ব্যাবহার করলো, স্বপ্ন দেখার মাত্রা কিছুটা কমালে সব ঠিক হয়ে যাবে। কাল্পনিক নাক ডাকার শব্দে আর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে না।
বিজ্ঞানের সুফল আর কুফল নিয়ে যদি কখন বিতর্ক হয়, তবে পরের দিনের ঘটনা তার একটা বিশাল বড় উদাহরন হতে পারে। ওই দিন রাতেই, অহনা মোবাইল ফোনের ভিডিও অপশনে যেয়ে, কাজলের নাক ডাকা রেকর্ড করলো। সকালে কাজলকে ভিডিও দেখাল। কাজল দেখে কিছু বলল না, কিছু একটা একটা চিন্তা করতে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। বুঝল, অহনার কাছে ঘায়েল হয়েছে। বক্সিং খেলায় চিৎপটাং হয়ে নক আউট হয়ে যাবার দশা।
রাতে কাজল বালিশ, কাঁথা নিয়ে বসার ঘরে সোফায় যেয়ে ঘুমাল।

অহনা প্রথমে এক হাত নিতে পারাতে খুশীই হল। যাক বাবা, অনেক দিন পরে একটু আরাম করে ঘুমান যাবে। আর যাই হোক, এত শব্দের তার ঘুমান সম্ভব না। এই সব ভাবতে ভাবতে আসলেও অহনা ঘুমিয়ে পড়ল। আহ কি আরাম। পৃথিবীতে ঘুমের থেকে প্রশান্তির জিনিষ কি আর কিছু আছে?
স্বপ্নের মধ্যে মনে হতে থাকলো, সে নাক চুলকানোর কিছু একটা দেখছে।  একটু পরে মনে হতে থাকলো, নাকটা মনে হয় বাস্তবেই চুলকাচ্ছে।  চোখ খুলে বুঝার চেষ্টার করতে লাগলো, স্বপ্নের নাক চুলকানি কেন বাস্তব মনে হচ্ছে।  কিন্তু, সেই সুযোগটা বেশীক্ষণের জন্যে পেল না। আরম্ভ হল, হাচ্চু, হাচ্ছু, হাচ্ছু। এক, দুই, তিন,…………একুশ, বাইশ……তেত্রিশ। শুধু নাক না, গলা, চোখ সব চুলকাচ্ছে। বুঝল এলারজি এ্যাটাক। বিয়ের পরে এই প্রথম। পৃথিবীর কোন ওষুধ এখন কাজ করবে না।
কাজল পাশের ঘর থেকে ছুটে আসলো। ভয় পেয়ে গেল। যুদ্ধের সব কথা ভুলে যেয়ে মানবতা এসে মনে ঠায় নিল। চল, চল, তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। অহনা হাচ্চুর ফাঁকে ফাঁকে বললে, একটু… পরে… কমে… আসবে………।
পরের দিন নাস্তার টেবিলে, অহনা কাজলকে তার এলারজি এ্যাটাকের কথা বলল। এই সমস্যা না বলে কয়েই আসে। বেশ কয়েক বছর আসে নি।  কিন্তু আসলে কিছুক্ষণ খুব যন্ত্রণার মধ্যে থাকে। কাজল ভাবল, কালকের ঘটনার প্রতিশোধ এত অল্প সময়ের ব্যাবধানে আসলো। ভাগ্যটা সুপ্রসন্ন মনে হল। বুকের ছাতিটা ফুলিয়ে বলল, আমার নাক ডাকার শব্দে একটা মানুষের ঘুমের সমস্যা হয়েছিল। আর তোমার হাচ্ছুর শব্দে পুরো পাড়ার মানুষ ঘুম থেকে উঠে বসেছিল। দ্বিতীয় ইনিংসে প্রথম বলে ওপেনিং ব্যাটসম্যানকে বোল্ড আউট করার মহা প্রসাদ পেল। আহ, কি আনন্দ! প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করা গেল।

কাজল বসার ঘরে অপেক্ষা করছে। এই বুঝি অহনা বের হয়ে গেল। মাথার মধ্যে কত চিন্তা কাজ করছে। এক সময়কার লাস্যময়ি অহনা  আর তার সাথে হাসি মুখে কথা বলে না। তার সব কিছুতেই মহা বিরক্তি। এখন দু জন দুই ঘরে শোয়। এটা কি কোন দাম্পত্য জীবন হল। একটু নরম শরীরের ছোঁয়া নে পেলে কি আর ঘুমান যায়। কিন্তু অহনা যখন ওই সবের কোন মর্যাদা দিতে পারে না, তখন আবার কিসের কি?
ঘণ্টা খানেক বসে, উঁকি দিয়ে বুঝার চেষ্টা করলো অহনার এত সময় লাগছে কেন।  অবাক কাণ্ড। অহনার কানের মধ্যে হেড ফোন দিয়ে একটা গল্পের বই পড়ছে। কি অদ্ভুত, ওর না চলে যাবার কথা। দেখা যাক আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে।
পরের বার যেয়ে দেখা একই অবস্থা। অহনা একেবারে বইয়ের মধ্যে ঢুকে আছে। মাঝে মাঝে আবার মুচকি মুচকি হাসছে। হয়তো হাসির কোন গল্প। কাজল যেয়ে অহনার পিঠে টোকা মেরে, হাতের ইশারায় বলল, কি ব্যাপার, তোমার যাবার কি হল?
অহনা একেবারে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে, কানের হেড ফোন খুলে, বইটা পাশে রেখে কাজলের দিকে তাকাল। সেই, সেই দৃষ্টি। আগে যখন ওরা প্রেম করত, তখন কোন কারণে যদি এক দিন যদি দু জনের দেখা না হত, সেই দৃষ্টি।  অহনা সেই অপলক দৃষ্টি দিয়ে কত হাজার কথা না বলত। কোথায় ছিলে, কেমন ছিলে, তোমাকে না দেখে চোখটা শুকিয়ে পাথর আর বুকটা মরুভুমি হয়ে গেছে। একেবার কাজলের বুক ছিদ্র হয়ে গলে পড়তে লাগলো। এখন বললে, কাজল, অহনার জন্যে সুন্দরবন থেকে নিজের হাতে একটা মায়াবী চোখের হরিন নিয়ে আসতে পারে। আরেক কথায় এভারেস্টের চূড়ায় যেয়ে এক মুঠো বরফ নিয়ে আসতে পারে। এই মেয়েকে ছেড়ে এক মুহূর্ত থাকা সম্ভব না।
কাজলের অবাক হওয়ার আরও বাকি ছিল। অহনা কাজলের কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে ফিস ফিস করে বলল, তোমার পাশের সোফায় গত তিন রাত একটা মেয়ে যেয়ে ঘুমায়, তা কি তুমি জান। আসলে অহনা, গত কয় রাত কাজল ঘুমিয়ে যাবার পরে তার পাশের সোফায় যেয়ে শোয়, আবার সকালে কাজলের উঠার আগে চলে আসে। অহনা বলতে লাগলো, তোমার নাক ডাকার শব্দ, এখন আমার তুলির মত, ঘুম পাড়ানির গান মনে হয়।
কাজলের সাথে সাথেই অহনার সব কিছু মিষ্টি মনে হতে লাগলো। এ যে চিনির থেকে বেশী মিষ্টি, গুড়ের থেকে বেশী মিষ্টি, মধুর থেকে বেশী মিষ্টি। এই মিষ্টিতে কোন ক্লান্তি নাই। এ যে একেবারের অন্য রকম মিষ্টি।  যে এ মিষ্টির সাধ এক বার পেয়েছে, সে-ই শুধু জানে এ কি রকম মিষ্টি।
পারিবারিক তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধ অনির্দিষ্ট কালের জন্যে মুলতবী হয়ে গেল।

 

মায়ের ভালোবাসা

আমার মা হল মেসবাড়ির বাবুর্চি । সে ঢাকা শহরের অনেক মেসে এবং স্কুলের শিক্ষকদের একটি হলে রান্নাবান্না করেন। তার রান্নার হাত অসাধারণ। কিন্তু তার চেহারা অনেকাংশে কুৎসিত কারন তার বামচোখ নেই । আর একচোখ না থাকায় তাকে দেখতে বেশ খারাপ লাগে । আমি যখন স্কুলে ভর্তি হই তখন স্কুলের বাচ্চারা আমাকে দেখলে বলে উঠত
-কানা বেডীর(মহিলার)ছেলে যায়। আমার বয়স তখন অনেক কম আর সেই কারনে আমি আমার মাকে ঘৃণা করতে লাগলাম। তিনি আমার ঘৃণাকে নিয়ে হাসতেন। আমি রাগ করলে ও কিছু বলতেন না । নিজের খাবার না খেয়ে তিনি আমাকে খেতে দিতেন । তিনি আমাকে অনেক ভালোবাসতেন কিন্তু আমি তা বুঝতে পারতাম না।
আমাদের স্কুলে  আমার মা আমাকে একদিন শুভেচ্ছা জনাতে এবং দেখতে এল । কিন্তু আমি তাকে দেখে বিভ্রান্ত হয়েছি । কারন সকলে আবার পুনরায় আমাকে নিয়ে হাসি তামাশা করতে রাগল । এরপর বাড়ি গিয়ে আমি মায়ের সাথে বেশ বকাবকি করলাম। তাতে ও আমার মা কিছু বলল না । তিনি তার একচোখ ওয়ালা মুখ দিয়ে আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন । তার অন্য চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছিল।
আমি নিজেকে শেষ করে ফেলতে ছেয়েছিলাম।আমি আরো চেয়েছিলাম আমার মা যেন পৃথিবী থেকে চলে যায়। আমার মা যদি শুধু আমার জন্য হাসির উদ্রেক করে থাকে তাহলে অবশ্যই তার  মরা উচিত।
একদিন সকালে আমি বাড়ি ছেড়ে সকলের অগচরে পালিয়ে গেলাম । অনেকদুর যাবার পর আমার খিদে লাগছিল । আমি তখন রাস্তার পাশের একটি দোকানে বসে বসে কাঁদছিলাম। সেই সময় একজন ভদ্রলোক আমাকে তার বাড়ি নিয়ে যায়।
দিনের পর দিন চলে যায় আমি বেশ ভালো লেখাপড়া করে অনেক বড় একটা চাকুরী পাই । এরমধ্যে আমি আমার মায়ের কথা ভুলে যাই । একদিন অফিসে বসে কি যেন করছিলাম। তখন কেউ একজন বলল কানা মহিলাটা আজ সকালে মারা গেছে । বুকের মাঝে কেমন যেন করে উঠল । বাইরে এসে খোজ নিলাম। সকলে বলল অফিসের পেছনে এক মহিলা থাকত । আজ থেকে অনেক বছর পূর্বে তার ছেলে হারিয়ে গিয়েছিল সারাদিন তাকে খোজত আর এই অফিসের বারান্দায় বসে কাঁদত।
অফিসের পিয়নকে সাথে নিয়ে আমি সেখানে গেলাম এবং লাশের মুখের ঢাকনা সরিয়ে দেখতে পেলাম এই আমার মা । আমি বলে চিৎকার করে উঠলাম। কিন্তু আমার চিৎকার শুনার জন্য মা তখন আর বেঁচে নেই।
এমন সময় একজন বৃদ্ধ এসে বলল বাবা শিপন এতদিন পর এলি । এদিকে আয় বলে বৃদ্ধ আমাকে তার ঘরের সামনে নিয়ে গেল । বৃদ্ধ ঘর থেকে মলিন একটি চিঠির খাম নিয়ে এসে আমার হাতে দিল ,এবং বলল তোর মা এটা তোকে দিতে বলেছিল । যাক এবার তোর মায়ের আত্না মরে ও শান্তি পাবে। সারদিন মায়ের দাফন নিয়ে ব্যাস্ত থাকলাম । সন্ধ্যায় নিজের বিশাল বাড়ির বারান্দায় বসে চিঠিটি খুললাম।
বাবা শিপন
দোয়া করি তুমি ভাল এবং সুখে আছ। আজ তোমার সামনে আমার কুৎসিত মুখ নিয়ে আসিনি বাবা। আজ এই চিঠিতে আমি তোমাকে লিখছি । আমি জানি তুমি বিরক্ত হচ্ছ তারপর ও লিখছি । পুরো চিঠিটা পড়বে কিন্তু।
তোমার বয়স তখন পাঁচ বছর আমি তোমাকে নিয়ে একদিন রিকশা করে যাচ্ছিলাম। হথাত পেছন থেকে গাড়ির ধাক্কায় তুমি পড়ে যাও । রাস্তার মাঝে ইটের সাথে গুঁতা লেগে তোমার বাম চোখ নষ্ট হয়ে যায় । আমি মা হয়ে তা সহ্য করতে পারছিলাম না। ডাক্তার বলল নতুন চোখ লাগালে তুমি দেখতে পাবে , তাই মা হিসাবে তোমাকে এক চোখ কানা নিয়ে ঘুরতে দেখা আমার দ্বারা সম্ভব নয় । আর সেই কারনে আমি আমার নিজের চোখ তোমাকে দিয়ে দিয়েছি । কিন্তু তুমি কোনদিন ও জানতে চাওনি আমি কেন কানা হয়েছিলাম। সুখে থেক বাবা।
ইতি
তোমার একচোখ কানা কুৎসিত
মা।
আমার চোখ দিয়ে তখন পানি ঝরছিল আর আমি জোরে চিৎকার দিয়ে বলে উঠলাম মা ফিরে এস মা। আমায় ক্ষমা কর মা , ক্ষমা কর ।

 

ভালবাসার গল্প


সকালবেলাতেই এমন একটা বিশ্রী কান্ড ঘটে যাবে অনীনদিতা ভাবতেই পারি নি । মেজাজটা একটু খারাপই হল বেটা ব্রাঞ্চ ম্যানেজারের উপর ।
বেটা নিজেকে ভাবে কি ?
ম্যানেজার হয়েছে বলেই কা যা ইচ্ছা তাই বলে যাবে !
একটু খানি দেরি হয়েছে বলে বেটা কত গুলো কথা শুনিয়ে গেল !
আরে আগে শুনবিতো দেরিটা কেন হয়েছে । তা না প্যাকপ্যাক প্যাক ।
অনীনদিতা মনে মনে আরো কয় কথা শুনিয়ে দিত ব্যাটা কে কিন্তু মোবাইলের ম্যাসেজ টোনটা বেজে উঠল ।
অনীনদিতা মনটা চট করে ভাল হয়ে গেল । যদিও এখনও ও সিওর না যে মেসেজটা কে পাঠিয়েছে তবুও মন বলছে কাঙ্খিত মেসেজটাই এসেছে । ইনবক্স খুলে মনটা আরো একটু খুশি হয়ে উঠল ।
ফাজিল ছোটরাটা ই পাঠিয়েছে । অনীনদিতা ম্যাসেজ ওপেন করল ।
:কি খবর ?
কি খবর !!
আর কোন কথা কি নাই ?
প্রতিদিন একই লাইন দিয়ে কথা শুরু করে । অনীনদিতা মনে মনে বলে আমি নিউজ চ্যানেল নাকি যে তোমাকে প্রতিদিন খবর পড়ে শোনাবো ।
আপনাদের এখন শোনাবো শিরোনাম তারপর বিস্তারিত ।
অনীনদিতা মেসেজের রিপ্লে লিখে পাঠাল
:খবর জানতে হলে এটিএন নিউজ ওপেন করুন । আমি কোন খবর টবর জানি নি ।
কিছুক্ষনের ভিতর রিপ্লে এসে হাজি ! একগাদা স্মাইলি ।

শেষে লেখা মেজাজ
:কেন খারাপ ?
অনীনদিতা লিখলো
:ঝাড়ি খেয়েছি !
:একা একটাই খেলে ? একটু বললেও না ?
:ইয়ার্কি মেরো না তো ! মেজাজ এমনিতেই খারাপ । দিনটা ভাল ভাবে শুরু হল না ।
পরের মেসেজে রিপ্লে আসলো
:চিন্তা করনা দিনটা ভালভাবে শুরু না হলেও শেষটা সুন্দর ।
তারপর একটা স্মাইলি ।
অনীনদিতার মনটা আরো বেশি ভাল হয়ে গেল ।
অনীনদিতার কেন জানি মনে হল ছেলেটা নিশ্চই ঠিক বলছে ! কিন্তু কিভাবে ? যাক সে বিষয়ে এখন চিন্তা না করলেও চলবে । অনীনদিতা লিখে পাঠাল
:আচ্ছা আমাদের দেখা হবে কবে ?
:কোন দিনও না ।
সাথে একটা মন খারাপের স্মাইলি ।
:কেন ?
:কারন আমাকে দেখার পর তোমার আর আমাকে ভাল লাগবে না । আমি অতি সাধারন একটা ছেলে ।
অনীনদিতা একটু রাগ হল ছেলেটার উপর ।

রাগের ইমো পাঠাল কিছু ।
:কি হল ?
অনীনদিতা লিখল
:আমি কিন্তু তোমাকে না দেখেই তোমার লেখা পছন্দ করেছি ।
:হু । বুঝলাম ।

আরো কিছুক্ষন এসএমএস চ্যাটিং চালিয়ে যাবার ইচ্ছা ছিল কিন্তু ফাজিল ম্যানেজার এতোগুলো ফাইল দিয়ে পাঠাল । সব গুলো চেক করতে হবে ।
অনীনদিতার মেজাজটা আবার খারাপ হল । ব্যাটা ইচ্ছা করে এই গুলা ওর কাছে পাঠিয়েছে ।
আরে ব্যাটা একটু দেরি না হয়েছে অন্য কিছু তো না ! অনীনদিতার মন একটু খারাপ । ব্যাংকের ফাইল তো একটু মনযোগ সহকারে দেখতে হয় তা হলে ভুল হবার সম্ভাবনা থাকে । আর ভুল হলে তো ম্যানেজার বেটা আবার বকাবকি করবে ।
অনীনদিতা এসএমএস লিখে পাঠাল
:খুব কাজের চাপ ।
:ও ! এখন কি আর মেসেজ পাঠাবো না ?
মন খারাপের ইমো । ও দিক থেকেও মন খারাপের ইমো ।
নাহ ! দিনটা যেমন বাজে ভাবে শুরু হয়েছছিল , দিনটা যাচ্ছেও খারাপ ভাবে ।

ইদানিং অনীনদিতার কি যে হয়েছে মনে হয় যেন সারাটা দিন ছেলেটার সাথে কথা বলতে মত চায় । কয়দিন আগেও ছেলেটাকে চিনতো না ছেলেটাকর কিন্তু এখন এমন একটা ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে যে ছেলেটাকে এসএমএস না পাঠালে ভালই লাগে না ।
কখন কি করছে কি করবে মন ভাল কিনা আবার ওর মান ভাল কিনা সব কিছু বলতে ইচ্ছা করে ! ওর কাছ থেকেও শুনতে ইচ্ছা করে !
কথাও বলতে ইচ্ছা করে খুব কিন্তু ফাজিল ছেলেটা ফোন রিসিভ করে না ।
অনীনদিতা অনেক বার কারনটা জানতে চেয়েছে । কিন্তু ছেলেটা স্পষ্ট করে কিছুই বলে নি । কেবল বলেছে যে সময় আসুক ! তারপর !!
কবে সময় আসবে !
খুব রাগ হয় ছেলেটার উপর কিন্তু কিছু বলতে পারে না ।

হাতের কাজ গুল শেষ করতে করতে প্রায় দুপুর হয়ে গেল । একটু পরেই লাঞ্চের ব্রেক । যাক একটু সময় পাওয়া গেল । এখন একটু খোজ নেওয়া যাক !
আচ্ছা ছেলেটা কি করছে ?
ওর কথা কি ভাবছে ?
অনীনদিতা নিখে পাঠালো
: এতো কাজের চাপ । তবুও তোমাকে মিস করছি !
অনীনদিতা মেসেজের জন্য বসে রইলো কিন্তু কোন রিপ্লে এল না ।
কি হল ?
এমন তো হয় না !!
ছেলেটা কখনও মেসেজের রিপ্লে দিতে দেরি করে না ,
আবার পাঠালো !
: তোমাকে মিস করছি ! খুববববববব !!!
কোন রিপ্লে নাই !!
অনীনদিতার মনটা এবার সত্যি খারাপ হল ।
ছেলেটা বলেছিল দিনটা ভাল যাবে ! কিন্তু কোথায় যাচ্ছে ভাল !
কোথায় তুমি ??
তোমার কথা খুব মনে পড়ছে !
কেন রিপ্লে দিচ্ছ না ?
অনীনদিটার সত্যি এবার কান্না আসতে লাগলো !
কিন্তু এতো লোকের ভিতর কেঁদে ফেলাটা কি লজ্জার হবে !!

-ম্যাম, আমার একটা নতুন একাউন্ট খোলা দরকার ছিল ।
অনীনদিতার মেজাজটা একটু খারাপ হল !
ও নিজে বাঁচছে না নিজের জ্বালায় আর এই ব্যাটা ব্যাটা এসেছে একাউন্ট খুলতে !
এই একাউন্ট খুলে তুই কি করবি ?
বিজনেস ম্যান হবি ?
তারপর হলমার্ক কেলেঙ্কারী করবি ।
অনীনদিতা ভাল করে তাকালও না সামনে বসা ছেলেটার দিকে ।
মনেমনে বলল
ব্যাটা দুরে গিয়ে মর ।
-ম্যাম ! আমার একাউন্ট টা !
অনীনদিতা মোবাইলটা আর একবার চেক করলো ।
নাহ ! কোন রিপ্লে আসে নি !
ছেলেটা কোথায় গেল !!
অনীনদিতা মোবাইল থেকে মুখ না তুলেই বলল
-দেখুন আমি একাউন্ট খুলি না । আপনি পাশের টেবিলে যান !
-আমি ওখানেই গিয়েছিলাম । উনি খুব বিজি ! আর আপননি তো ফ্রী আসেন । একটু দেখেন না প্লিজ !
এই ব্যাটা আমি ফ্রী তো তোর কি । তুই বলার কে আমি ফ্রী কি না !! কিন্তু কথা গুলো বলতে পারলো না । এরকম কথা বলা যায় না ।
অনীনদিতার পাশের টেবিলের সোমা বলল
-অনি, একটু দেখ না । আমি খুব বিজি !
অনীনদিতা অনিচ্ছা সত্তেও নতুন একাউন্ট খোলার ফর্ম টা নিল ।
-নাম বলুন ! পুরো নাম বলবেন ।
ছেলেটা বলল
-আমার নাম তানভীর । অপু তানভীর !
অনীনদিতার বুকের ভিতর কেমন করে উঠল যেন । অনীনদিতা অনুভ করল যে ওর বুকের বাম পাশটা কেমন করে ফালানো আরাম্ভ শুরু করেছে ।
অনীনদিতা এতোক্ষন সামনে বসা ছেলেটার দিকে ভাল করে তাকাও নি । ও ছিল নিজের ভাবনায় !
কিন্তু এবার তাকালো !
অপুকে এতোদিন কেবল কম্পিউটার স্ক্রীনেই দেখছে । আজকে এই প্রথম বারের মত সামনা সামনি দেখলো !
কেমন একটু হাসি মুখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে !
অনীনদিতার খুব রাগ হল ।
রাগ না অভিমান হল অপুর উপর ।
এমন ভাবে ওকে কষ্ট দিতে পারলো ছেলেটা ?
ওকে কতবার মেসেজ পাঠাল কিন্তু সামনে বসে মজা দেখছিল । এই জন্য একটা মেসেজেরও জবাব দেয় নি !!
ফাজিল ছোকরা !!
আমাকে কষ্ট দিয়ে মজা পাচ্ছ না ?
অনীনদিটা অনুভেব করলো ওর চোখে পানি চলে এসেছে । এই পানি কিছুতেই আটকানো যাবে না !
অনীনদিতা নিজের ডেস্ক ছেড়ে উঠে বাধরুমের দিকে দৌড় দিল ।
যাওয়ার সময় কেবল একটা আওয়াজই ওর কানে এল
-এই কোথায় ……..

অনীনদিতা বাধরুমের কল ছেড়ে অনেকক্ষন কাঁদলো । কিন্তু ঠিক কি কারনে কান্না আসছে এই ব্যাপারে ও ঠিক মড় সিওর না ।
অপুর উপর অভিমান হচ্ছে ?
না ! এমন তো হবার খুব একটা কারন নেই !
অপু ওকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছে !
অনীনদিতা এর আগে অনেক বার অপুর সাথে দেখা করতে চেয়েছে । কত বার রাগ করেছে কিন্তু অপু করে নি । কিন্তু আজ এই রকম অপ্রত্যাশিত ভাবে অপুকে সামনে দেখে অনীনদিতার অবেক কোন বাধা মানে নি । তাই হয়তো এই কান্না !!

একটু ধীর স্থির হয়ে আবার যখন অনীনদিতা নিজের টেবিলে ফিরে এল তখন অপুকে কোথাও দেখতে পেল না ।
সোমাকে জিজ্ঞেস করলো
-এই ছেলেটা কোথায় গেল রে ?
-তুই ওভাবে চলে গেলি কেন ?
-আহা ! ছেলেটা কোথায় ?
-একাউন্ট খোলা শেষ ! এই তো এলটু আগেই বের হয়ে গেল ।
-কি !

কোথায় গেল তুমি । অনীনদিতা আবার ঝরের গতিতে বাইরে বেড়িয়ে এল । এদিক ওদিক তাকাতেই দেখলো এটিএম বুথের সামনে অপু দাড়িয়ে আছে !
অনীনদিতা কাছে গিয়ে বলল
-এমন কাজটা না করলে কি হত না ?
অপু কোন কথা না বলে কেবল একটু হাসলো !!
-কথা বল না কেন ?
-কথা বলার জন্য তো সারাজীবন পড়ে আছে । আগে একটু দেখে নেই তোমাকে !
-কেন দেখার জন্য সারা জীবন পড়ে নেই?
অপু কোন কথা না বলে কেবল তাকিয়েই রইলো অনীনদিতার দিকে !!
কি গভীর চোখেই ছেলেটা তাকিয়ে আছে !!
অনীনদিতার চোখ কেন জানি আবার ভিজে উঠল ।
 ভাবনা

ভাবি পরের সকালটা যেন আর সকাল না হয়,
ভাবি একটা ঘোলাটে দিনের কথা,
অথবা গাঁঢ় কোনো অন্ধকার।
যদিবা ক্ষীণ চেনা যায় এমন চাঁদনী রাত রয়,
অনন্ত কাল ধরে; সারিবদ্ধ মাঁচা জুড়ে কুমড়োর লতা,
মুহুর্তের জন্যও হবেনা সবুজ; আঁধারে শুধু কালোর কারবার।
এর মাঝেও অতীতের পর্দা ঢাকা প্রাণীর হাড়ে লেখা প্রতিফলিত রূপালীর জয়।

বাঁশ ঝাড়ে শিকারীর বেশে বসা বর্ণহীন বর্ণিল মাছরাঙা,
গাছের শাখায় কাঠ ঠোকরার ঠোক ঠোক ছাড়া, সাড়া নেই বহু দূর।
মাঝে মাঝে কেবল বাতাসের শু শু মধুর সুরেলা,
অথবা শব্দ কখনো কোনো অদূরে অজানায় অশথের প্রাসাধ ভাঙা।
চেয়ে থাকা আকাশের বুকে আশ্রিত অংখ্যা নূর,
অসীমের পথে চলন্ত কল্পনার ভেলা,
একটা হৃদয় বহু কাল ধরে যেটা চাঙা।
 হারানোর তালিকা


আজ কেন জানি কাঁদতে ইচ্ছা করছে,
অযথাই অবিরত ভিজছে এ চোখ জোরছে।
হারানোর তালিকাটা তো তেমন লম্বা নয়,
তবুও মাঝে মাঝে এ মন অশ্রুসজল হয়।
শৈশব
বাবা
একত্রে মূহুর্তগুলো
হারানোর তালিকা ছোট হলেও তীব্রতা প্রচন্ড;
হাসিমুখে ভুলে গেলেই বরং ভাববো নিজেকে ভন্ড।

চোখের বন্যা থামার অপেক্ষায় ... ...
কোন কিছু পাওয়া বা  চাওয়ার আশায় নয় ,  শুধু দেওয়ার প্রত্যয়ে এই ব্লগ এর যাত্রা শুরু । আপনাদের ভাল লাগায় আমাদের সার্থকতা ।

......... H.E